আত্মা কিভাবে ৮৪ লক্ষ যোনি ভ্রমণ করে? কোন কোন জন্মের পর মানব জন্ম পাওয়া যায়? 84 Lakh Births Explained

আপনি নিশ্চই শুনে থাকবেন, ৮৪ লক্ষ জন্মের পর আমরা এই দুর্লভ মানব জনম লাভ করে থাকি। অর্থাৎ, আমাদের এই মানব জন্মের আগে আমরা ৮৪ লক্ষ যোনি ভ্রমণ করে এই মানব জনম পেয়েছি। কিন্তু জানেন কি এই আমরা এই ৮৪ লক্ষ জন্মে কোন কোন রূপে জন্মেছি এবং মৃত্যু বরণ করেছি? আসুন সনাতন পৌরাণিক শাস্ত্রের আলোকে জেনে নেওয়া যাক এই ৮৪ লক্ষ জন্মের বৃত্তান্ত।

পুরাণি শাস্ত্রে যাহা আছে বর্ণন

শুন সে চুরাশি লক্ষ যোনি বিবরণ।

আপনারা নিশ্চই অবগত আছেন যে, ঈশ্বর পৃথিবীতে দুই শ্রেণীর প্রাণ সৃষ্টি করে থাকেন। এর প্রথমটি হচ্ছে স্থাবর, তথা যারা একই স্থানে জন্মে এবং একই স্থানে মৃত্যুবরণ করে। আমাদের আশেপাশের গাছপালা, তরুলতা এই শ্রেণীর উদাহরণ। আর দ্বিতীয় শ্রেণীটি হচ্ছে জঙ্গম। অর্থাৎ, যে শ্রেণীর জীব চলাচল করতে পারে।

তো ঈশ্বর স্বর্বপ্রথমে আমাদের সৃষ্টি করেন স্থাবর রূপে। এই রূপে আমরা গাছপালা, তরুলতা বা বৃক্ষরাজি হয়ে পৃথিবীতে শোভা দান করে থাকি। কিন্তু এভাবে কতকাল? রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে, ক্ষরায় শুকিয়ে বা ঝড়ে ভেঙে নিরন্তর চলতে থাকে বৃক্ষ জন্ম। কিন্তু অবশেষে কুড়ি লক্ষ বার গাছপালা রূপে জন্মের শেষে আমাদের জন্ম হয় তুলসী বৃক্ষ রূপে। আর সেই তুলসী গাছের পবিত্র পত্র যখন ভগবান শ্রীকৃষ্ণের পাদপদ্মে অর্পিত হয় তখনই আমাদের মুক্তি মেলে বৃক্ষ জন্ম থেকে। কবি বলেছেন,

বিশ লক্ষ বার বৃক্ষ যোনিতে জনম

তাতে যত কষ্ট হয় অশেষ কারণ।

বিশ লক্ষ বার বৃক্ষ যোনিতে ভ্রমিতে

কত যুগ যুগান্তর যাবে ক্রমেতে।

তো বৃক্ষ জন্মের শেষে আমাদের জন্ম হয় জলজ জীব হিসবে। এই পর্বে আমরা কখনো মৎস্য, কখনো কূর্ম ইত্যাদি রূপ পরিগ্রহ করতে থাকি ঈশ্বরের কৃপা লাভের আশায়। কিন্তু এভাবেও বা যাবে আর কতকাল? অবশেষে আসে মুক্তির সময়। ৯ লক্ষ বার জলজ প্রাণী হিসেবে জন্মের পর আমাদের জন্ম হয় শঙ্খ রূপে। আর যেদিন সেই জলশঙ্খের জল অর্পিত হয় শ্রীগোবন্দের চরণে সেদিনই আমাদের মুক্তি মেলে জলজ যোনী থেকে। তাই কবির ভাষায়,

মৎস্যে কূর্মে নয় লক্ষ বার জন্ম হয়

ভ্রমিতে পাড়িতে জীব কত কষ্ট পায়।

নয় লক্ষ বার জন্ম হয় ধীরে ধীরে

ঘরবাড়ি ঠিক নাই যথা তথা ফিরে।

জলজ যোনী থেকে তো মুক্তি পাওয়া গেল, তবে কি এবার মিলবে মানব জনম? না, এবার আমাদেরকে জন্ম নিতে হয় কীট পতঙ্গ রূপে। কখনো মাছি, কখনো মশা, শুঁয়োপোকা, কেঁচো ইত্যাদি রকমের কীট হয়ে বার বার জন্ম আর বার বার মৃত্যু। আর এভাবেই কেটে যায় আরও ১১ লক্ষ জনম। কীট জন্মের শেষে জীবের জন্ম হয় মৌমাছি রূপে। আর সেই রূপে আমরা মধু সংগ্রহ করে জমা করি মৌচাকে। এবং যেদিন আমাদের সেই সংগৃহীত মধুর একটি ছোট্ট বিন্দু রাধা-মাধবের ভোগে অর্পণ করা হয়, সেদিনই আমাদের মুক্তি মেলে কীট যোনী থেকে।

কৃমি জন্ম একাদশ লক্ষ ভ্রমিয়া বিশেষে

দশ লক্ষ বার পক্ষী যোনি শেষে।

তো কীট বা কৃমি জন্মের পরে আমাদের জন্ম হয় পক্ষীকুলে। কত-শত-হাজারো পক্ষী হয়ে আমরা বিচরণ করি অন্তরীক্ষে। তবে এ জন্মেও কখনো সর্পের ভয়, কখনো তীব্র ক্ষুধায় খাদ্যাভাব, কখনো ঝড় জলে নীড় ছিড়ে পড়া ইত্যাদি রকমের যন্ত্রণা সহ্য করতে হয় আমাদের। তবে হ্যাঁ অন্য জন্মগুলোর মত এ জন্মেরও শেষ আছে। ১০ লক্ষ বার পক্ষীকুলে জন্ম হওয়ার পর আমাদের জন্ম হয় ময়ূর রূপে। আর যেদিন সেই ময়ূরের পালক মোহন বংশীধারীর চূড়ামণিতে স্থান পায়, সেদিনই আমরা মুক্তি লাভ করি পক্ষী জনম থেকে।

আরও পড়ুনঃ  নারী কি সত্যিই দেবী? নারীত্ব থেকে দেবীত্বের যাত্রা কেমন? Women and Goddess in Hinduism

কি ভাবছেন এবার কি পাবো সেই সাধের মানব জনম। না এবারও নয়। এবার আপনাকে জন্ম নিতে হবে পশুকুলে। অর্থাৎ কখনো মাংসাশী বাঘ, সিংহ বা নেকড়ে রূপে, আবার কখনো মাংসাশীদের ভোজনরূপে তথা মৃগ, ছাগ ইত্যাদি রূপে। আর এভাবে খাদ্য ও খাদকের রূপে আপনাকে জন্ম নিতে হবে ৩০ লক্ষ বার। এরপর একদিন শ্রীমধুসূদনের কৃপায় আমাদের জন্ম হয় ধেণু তথা গরু রূপে। এবং গাভীর গোদুগ্ধ দোহন করে যখন গোবর্দ্ধনধারীর ভোগে অর্পণ করা হয় তখনই আমাদের মুক্তি মেলে পশু যোনী থেকে।

তাই কবির ভাষায়,

ত্রিশ লক্ষ বার জন্ম পশুর যোনিতে

নানা রূপে কত কষ্ট পায় অবনীতে।

অবশেষে; গো যোনিতে জন্ম যে লয়

এর চেয়ে উত্তম জন্ম পশুকুলে নাই।

তো গোজন্মের পর আরও চার লক্ষ জন্মের পর আমরা লাভ করে থাকি দুর্লভ মানব জনম। তবে এখানে দুটি মত প্রচলিত রয়েছে। একটি মত বলছে এই চার লক্ষ জন্ম আমরা অবহেলিত মানব হিসেবে জন্ম নিয়ে থাকি।

গো যোনির শেষে পশু যোনি নাই

মানুষ্য যোনিতে এবার জন্ম তাঁর হয়।

মানব কুলেতে জন্ম চার লক্ষ বার

অপরূপ সে বারতা কহি সবিস্তার।

তবে অন্যমতে, গোজন্মের পর ৪ লক্ষবার বাণর জন্মে জন্মাতে হয় আমাদেরকে। এবং এভাবে ৮৪ লক্ষ জন্মের পর আমাদের জন্ম হয় মানুষ রূপে। তবে মানব কুলে জন্ম লাভ করার পরেও যদি আমরা আমাদের আত্মাকে মুক্তি না দিতে পারি, তাহলে আমাদেরকে আবারও এই ৮৪ লক্ষ রূপ পরিগ্রহ করতে হয়।

জন্মিয়া মানবকুলে আত্মা না উদ্ধারে

পুনঃ সে চুরাশি লক্ষ যোনি পথে ঘুরে।

বার বার জন্মলাভে কত কষ্ট পায়

শ্রীচরণ দাসে বলে নাইকো উপায়।

তাই আসুন আমরা সময় থাকতে মহান ঈশ্বরের চরণতলে আত্মসমর্পণ করি এবং শুদ্ধ কাজ ও ঈশ্বরপ্রেমের মাধ্যমে আমাদের আত্মাকে উদ্ধার করতে ব্রতী হই।

আরও পড়ুনঃ  হিন্দুরা কেন মূর্তি পূজা করে? বেদে / গীতায় এ সম্পর্কে কি বলা হয়েছে? Murti Puja in Hinduism

3/5 - (1 vote)

Leave a Comment

error: Content is protected !!