ধাতু পাষাণ মাটির মূর্তি কাজ কি রে তোর সে গঠনে। রামপ্রসাদী গানের এই চরনটি সকল দেব-দেবীর প্রতিমা বা প্রতীকের ক্ষেত্রে সত্য হলেও দেবাদিদেব মহাদেবের একটি শিবলিঙ্গের ক্ষেত্রে এর ব্যাতিক্রম দেখা যায়। শত সহস্র উপাচার উপেক্ষা করে যিনি মাত্র একটি বিল্বপত্রে সন্তুষ্ট হন, তিনি হলেন দেবাদিদেব মহাদেব। এই কারনে তিনি পৃথিবী ব্যাপী মানুষের পরম শ্রদ্ধার এবং ভালোবাসার স্থল। তার প্রতীক তথা শিবলিঙ্গে একটু জল ঢেলে একটি বেলপাতা অর্পণ করলেই যেন অগাধ প্রশান্তিতে ভরে যায় ভক্তের হৃদয়। তাই স্বয়ম্ভু শিবলিঙ্গের বাইরেও লক্ষ লক্ষ শিব মন্দিরের শিবলিঙ্গগুলো প্রতিনিয়ত সিক্ত হয় ভক্তের হৃদয়ের অর্ঘ্য দ্বারা। তবে পৃথিবীর প্রায় সমস্ত শিবলিঙ্গ প্রস্তর বা কংক্রিটের তৈরি হলেও একটি মাত্র শিবলিঙ্গ এর ব্যাতিক্রম। আজ্ঞে হ্যাঁ, আজ আমরা এমন একটি শিবলিঙ্গের কথা বলতে চলেছি যা পৃথিবীর একমাত্র জীবিত শিবলিঙ্গ। শুধু তাই নয় জীবিত সত্বার মত প্রতি বছর একটু একটু করে বেড়েও চলেছে এই শিবলিঙ্গটি। তো চলুন দর্শক আর দেরী না করে দেখে আসি সেই আশ্চর্যজনক শিবমন্দিরের রহস্যজনক শিবলিঙ্গটিকে।
নবম ও দশম শতকে শত সহস্র শিল্পী একত্রে শুরু করেছিল তাদের শিল্প স্থাপন। সেই শিল্পের মাধুর্য এতটাই প্রবল এবং তাদের সৃষ্টি শৈলী এতটাই দৃঢ় ছিল যে লক্ষ লক্ষ প্রস্তর খন্ডও হয়ে উঠেছিল জীবন্ত। হয়তো সেই সমস্ত শিল্পকলার স্পর্শে খাজুরাহো এখনও দেশ বিদেশের পর্যটকদের চোখের মণি। প্রস্তর খন্ডকে যে বহু রূপে রূপান্তর করা যায়, তার সব থেকে বড় প্রমাণপত্র বোধহয় রয়েছে খাজুরাহোয়।
বলছি মধ্যপ্রদেশের এক অন্যতম পর্যটন কেন্দ্রবিন্দু খাজুরাহো মন্দিরের কথা। নবম ও দশম শতক থেকেই শুরু হয়েছিল খাজুরাহ মন্দির নির্মাণের কাজ। সেই সময় খাজুরাহোতে ছিল চান্দেল রাজাদের রাজত্ব। তাদের তত্বাবধানে এখানে তৈরী হয়েছিল ৮৫টি মন্দির যার মধ্যে মাত্র ২২টি মন্দির এখনও পর্যন্ত টিকে থাকতে পেরেছে। এই ২২টি মন্দিরের মধ্যে রয়েছে বিষ্ণু, শিব, লক্ষণ, দুর্গা, কৃষ্ণ প্রভৃতি দেব দেবীর মন্দির। গোটা ওই অঞ্চলটিকেই ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটও বলা হয়ে থাকে। প্রতিদিন বিশাল পরিমাণে ভক্ত এসে ভিড় জমান ওই মন্দিরগুলোতে। এখানে দেখার মত মন্দিরগুলো হচ্ছে বিশ্বনাথ মন্দির, জগদম্বার মন্দির, লক্ষণ মন্দির, চিত্রগুপ্ত মন্দির, সূর্যদেবের মন্দির , কাণ্ডারিয়া মহাদেবের মন্দির এবং মাতঙ্গেশ্বর শিব মন্দির।
তবে এই মন্দিরগুলির মধ্যে সবথেকে উল্লেখযোগ্য মন্দির হল মাতঙ্গেশ্বর মন্দির। এই মন্দিরে এমন একটি শিবলিঙ্গ রয়েছে, যাকে বলা হয় পৃথিবীর একমাত্র জীবন্ত শিবলিঙ্গ। এই মন্দিরের গর্ভগৃহেই অবস্থিত এই রহস্যময় জীবন শিবলিঙ্গটি। এই শিবলিঙ্গর দৈর্ঘ্য বর্তমানে প্রায় ৯ ফুট । তবে রহস্যজনক ব্যাপারটি হচ্ছে প্রতি বছর শারদ পুর্ণিমার তিথিতে এই শিবলিঙ্গটি প্রায় এক সেন্টিমিটার করে বেড়ে যায়। এই ঘটনার সত্যতা স্বীকার করেছেন স্বয়ং মন্দিরের সেবক ও পুরোহিতগন। প্রতি বছর শারদ পুর্ণিমার রাতে তারা শিবলিঙ্গটির দৈর্ঘ্য মেপে মিলিয়ে দেখেন আগের বছরের পরিমাপ করা দৈর্ঘের সাথে। এবং আশ্চর্জনক হলেও সত্যি যে আগের বছরের পরিমাপকৃত দৈর্ঘ্যের সাথে বর্তমান বছরের পরিমাপকৃত দৈর্ঘ্যের বেশ কিছু তারতম্য দেখা যায়। স্থানীয় কিংবদন্তি বলছে, শিবলিঙ্গটি ঠিক যতটা মাটির উপরে আছে, ঠিক ততোটাই মাটির নীচেও রয়েছে। অর্থাৎ শিবলিঙ্গের মাটির উপরের অংশ এবং মাটির নিচের অংশের দৈর্ঘ্য সমানভাবেই বাড়ছে। পুরাণ মতে, ভগবান শিবের কাছে একটি মহামূল্যবান মার্কট মণি ছিল। এই মণিটি তিনি পঞ্চপাণ্ডবের জ্যেষ্ঠ্য পান্ডব ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরকে দিয়েছিলেন। যুধিষ্ঠির আবার এই মণিটি মাতঙ্গ ঋষিকে দিয়েছিলেন। এরপর মাতঙ্গ মুনি ওই প্রচণ্ড ক্ষমতা সম্পন্ন মার্কট মণিটি রক্ষা করার দায়ীত্ব অর্পন করেন রাজা হর্ষবর্মনকে। রাজা হর্ষবর্মন মণিটির সুরক্ষার জন্য মাটির নিচে পুতে রেখেছিলেন। কিন্তু তার অন্তিমকালে তিনি মণিটি হস্তান্তর করার মত কাউকে পান নি। তাই দেখভালের জন্য কাউকে না পাওয়া যাওয়ায়, ওই মহামূল্যবান মণিটি মাটির নীচে যে স্থানে পুতে রাখা হয়েছিল, সেখানেই একটি শিবলিঙ্গের নির্মান করা হয়। শিবলিঙ্গটির নাম দেওয়া হয় মাতঙ্গেশ্বর শিবলিঙ্গ। যেহেতু মাতঙ্গ ঋষি রাজা হর্ষবর্মনকে মণিটি দিয়েছিলেন, তাই শিবলিঙ্গের পাশাপাশি মণিটিকেও মাতঙ্গেশ্বর মণি বলা হয়। স্থানীয় মানুষের বিশ্বাস, এই মণির কারণেই এই মাতঙ্গেশ্বর শিবলিঙ্গটি প্রতি বছর সামান্য পরিমানে বর্ধিত হচ্ছে । জীবিত সত্বার ন্যায় প্রতি বছর শিবলিঙ্গের বেড়ে চলাটাকে নিয়ে স্থানীয় মানুষ এবং পর্যটকদের মধ্যে আগ্রহের ঘাটতি নেই। প্রতিদিন দেশ বিদেশ থেকে হাজার হাজার ভক্ত, পুন্যার্থী, পরিব্রাজক এবং রহস্যসন্ধানী মানুষের আনাগোনায় পরিপূর্ণ হয় মন্দির প্রাঙ্গন। মন্দিরের পুরোহিতদের বক্তব্য, এই শিবলিঙ্গের উপররের অংশ স্বর্গের দিকে এবং নীচের অংশ ধীরে ধীরে পাতালের দিকে যাচ্ছে। এই ভাবে শিবলিঙ্গের নীচের অংশ যেদিন সম্পূর্ণ পাতালে পৌঁছে যাবে, সেদিন কলিযুগের সমাপ্তি ঘটবে। তবে মন্দিরের পুরোহিতদের এই দাবীর বিপক্ষে কোন বৈজ্ঞানিক গবেষনা আজও জানা যায় নি। তারপরও মানুষের বিশ্বাসের চেয়ে শক্তিশালী পৃথিবীতে কিছু নেই আর কখনো ছিলও না।
তবে এই অঞ্চলে মাতঙ্গেশ্বর মন্দিরই একমাত্রে দর্শনীয় স্থান নয়। আশে পাশে মন্দিরগুলির গায়ে বিভিন্ন ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে থাকা নরনারীর মূর্তিও আপনাকে দারুনভাবে আকর্ষন করবে। হয়তো কোনো নারী চোখের কোণে কাজল পড়তে ব্যস্ত, কেউ হয়তো নৃত্যের ভঙ্গিতে আপনাকে আহ্বান জানাচ্ছেন, কেউ বা তার সঙ্গীর সাথে একান্ত সময় কাটাতে ব্যাস্ত। শুধু তাই নয়, ব্রহ্মা থেকে বিষ্ণু, মহাদেব থেকে রামচন্দ্র, অপ্সরা কিংবা প্রেয়সীদের সঙ্গে তারাও যেন একাকার হয়ে যেতে চেয়েছেন। দেখলে মনে হয় এই সমস্ত কিছুর প্রস্তুতকারী শিল্পী মন্দিরের প্রতিটি ভাঁজে ভাঁজে যেন শিল্পকলাকে মাধ্যম করে দেবতা ও মানুষের মাঝের যোগসূত্র ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন। এছাড়াও দর্শন করার মত এখানে আছে বিশ্বনাথ মন্দির, এবং সেই মন্দিরের সামনেই মহাদেব বাহন নন্দীর মন্দির বিরাজমান। সাত ফুট লম্বা এবং ছয় ফুট উচ্চতার মহাদেব বাহনের সারা দেহে রয়েছে বিভিন্ন দেবদেবীর খোদাই করা মূর্তি। শিল্পীর ছোঁয়ায় তারাও উত্তম। সেই সমস্ত দেবদেবীকে সঙ্গে নিয়েই সহস্র বছর ধরে সম্মুখে থাকা মহাদেবের পাহারায় বসে আছেন নন্দী।
খাজুরাহের কাছাকাছি আছে শিবসাগর দীঘি। এখানেই আছে খাজুরাহোতে তৈরী হওয়া প্রথম মন্দির, চৌষটযোগিনি। সেখানে রয়েছে গ্রানাইট পাথরে তৈরী ৩৭টি ক্ষুদ্র মন্দির। মধ্যযুগে এই সমস্ত জায়গায় তান্ত্রিকেরা তন্ত্র সাধনা করতেন। এখনও সেখানে কিছু কিছু তান্ত্রিকের আবির্ভাব ঘটে। গ্রানাইটের ওপর মূর্তি গড়া সম্ভব নয় বলে, এই মন্দির গুলি মূর্তিশূন্য হয়েই রয়ে গেছে বছরের বছর।
জনশ্রুতি রয়েছে পঞ্চপাণ্ডবের অজ্ঞাতবাস সম্পন্ন হয়েছিল খাজুরাহোর কাছাকাছি পান্নার জঙ্গলে। তবে তাদের বসবাসের কোন চিহ্ন তারা রেখে যাননি। কিন্তু এই জঙ্গলের মধ্যে তৈরি হয়েছে বেশ কয়েকটি ছোট ও বড় ঝর্ণা এবং তার জলে তৈরী হয়েছে এক মাঝারি আকারের জলাধার। সেই জলাধারের কাছেই গড়ে উঠেছে কয়েকটি গুহা। আর এই সমস্ত কিছুকে চারপাশ থেকে আবৃত করে রেখেছে বৃহৎ গাছপালার এক জঙ্গল। তবে, অনেকের মতে খাজুরাহো মন্দিরের শিল্পকলাগুলো নাকি অশ্লীল এবং দর্শন অযোগ্য। এ নিয়ে তর্ক-বিতর্কেরও শেষ নেই। আমরাও হয়ত ভবিষ্যতে এই শিল্পকলাগুলোর শ্লীলতা নিয়ে ভিডিও নিয়ে আসব। আর জানাবো আসলেই কি এগুলো অশ্লীল নাকি শিল্পের মাধ্যমে প্রাকৃতিক ধর্মকে ফুটিয়ে তোলার প্রয়াস মাত্র।