মঙ্গল ঘট,মঙ্গল ঘট প্রতিস্থাপন,মঙ্গলঘট,মঙ্গলঘট নকশা,মঙ্গল ঘট সম্পর্কে শ্রী শ্রী ঠাকুরের মঙ্গল বানী,মঙ্গলঘট প্রতিষ্ঠা,মনসা মঙ্গল বাংলা ভিডিও,ঘট স্থাপন,ঘট পূজা,পুজার ঘট স্থাপনের সহজ নিয়ম।
কবিগুরু রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত দুটি চরন দিয়ে শুরু করা যাক।
মার অভিষেকে এসো এসো ত্বরা,
মঙ্গলঘট হয় নি যে ভরা
সবার-পরশে-পবিত্র-করা তীর্থনীরে—
আজি ভারতের মহামানবের সাগরতীরে॥
সনাতন ধর্মাবলম্বীদের যে কোন পূজা পার্বন আরম্ভ করার আগে যে বস্তুটি প্রয়োজন তা হল ঘট। দেবী হোক বা দেব, দেবতার ছবি হোক বা প্রতিমা, বিধিমতে পূজা সুসম্পন্ন করতে হলে ঘটের ব্যাবহার অপরিহার্য। মাটি বা পিতলের তৈরি এই পাত্রগুলোকে নানা উপাচারে সজ্জিত করে, এবং তার গায়ে সিদুর দিয়ে স্বস্তিকা চিহ্ন অঙ্কন করে, দেবতার প্রতিমার ঠিক অগ্রভাগে স্থাপন করা হয় এই ঘট। কোন কোন ক্ষেত্রে দেব এবং দেবীর জন্য দেখা যায় আলাদা আলাদা ঘট। কিন্তু কখনো কি আপনার মনে এই ঘট নিয়ে কোন কৌতূহল জেগেছে? জানতে ইচ্ছে করেছে কি, কেন এই ঘট এত গুরুত্বপূর্ণ? কেনইবা দেবতার পূজার চেয়ে ঘটের স্থাপনাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে? ঘট স্থাপন করার জন্য যে উপকরণগুলো ব্যাবহার করা হয় তাদেরই বা কি তাৎপর্য? হ্যাঁ, আপনার মত আমরাও কৌতূহলী হয়ে খুঁজে চলেছি এসকল প্রশ্নের উত্তর। তাই সনাতন এক্সপ্রেসের আজকের আয়োজনে আপনার জন্য থাকছে পূজার ঘট সম্পর্কিত সমস্ত প্রশ্নের উত্তর। আশা করি এই আলোচনা শ্রবন করার পর নতুন সনাতনী জ্ঞানের সঞ্চার হবে আপনার মধ্যে, দূর হবে কৌতূহলের অন্ধকার এবং বিশুদ্ধ সনাতনী জ্ঞানের আলোয় আলকিত হবে জীবন।
ঘট কোন দেবী বা দেবতার মূর্তি বা প্রতিমা নয়। ঘট ভগবানের নিরাকার অবস্থার প্রতীক। আপনারা জানেন সনাতন ধর্মের প্রত্যেক দেবদেবী এক, অভিন্ন ও নিরাকার পরম ব্রহ্মেরই এক একটি সাকার রুপের প্রকাশ। অর্থাৎ, দেব-দেবীরা নির্গুন ব্রহ্মের এক একটি গুনবাচক নাম। তাই সনাতন হিন্দুরা পূজার সময় যেমন ভগবানের সাকার স্বরূপ কে পূজা করেন তেমনি নিরাকার স্বরূপকেও পূজা করে থাকেন । তাই ঘট স্থাপন প্রতি পূজাতে একান্ত আবশ্যক। ঘট স্থাপন ছাড়া পূজা করলে তথা ঈশ্বরের সাকার ও নিরাকার রূপের অর্চনা একসাথে না করলে, সেই পুজা অসম্পূর্ণ বলে মনে করা হয়।
সম্পুর্ণ ঘটকে মানুষের দেহের প্রতিরূপ হিসেবে প্রকাশ করা হলেও এর বিভিন্ন অংশ কিছুটা ভিন্নার্থ নির্দেশ করে। যেমন-
১) ঘটের চওড়া অংশ পৃথিবীকে নির্দেশ করে।
২) প্রসারিত কেন্দ্র জলকে নির্দেশ করে।
৩) ঘটের ঘাড় অগ্নিকে নির্দেশ করে।
৪) মুখের খোলা অংশ বায়ুকে নির্দেশ করে।
৫) ঘটের মুখের ডাব ও আমের পল্লব আকাশকে তথা উদারতাকে নির্দেশ করে।
৬) এবং সবশেষে আসে সম্পুর্ণ ঘট। আপনারা যারা পুজো অর্চনার সাথে নিত্য নৈমিত্তিকভাবে জড়িত, তারা অবশ্যই জানেন, ঘট কে আমাদের দেহের প্রতীক হিসেবে মান্যতা প্রদান করা হয়ে থাকে। শাস্ত্রমতে, আমাদের দেহকে দেহ ঘট বলে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। তাই দেহের প্রতিরূপ হিসেবে ঘট প্রত্যেক পুজোয় অপরিহার্য একটি উপাদান।
তো প্রথমেই জেনে নেওয়া যাক ঘট স্থাপন করার জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণগুলো কি কি?
আপনারা অনেকেই জানেন ঘট স্থাপনের জন্য প্রয়োজন- পঞ্চশস্য, পঞ্চগুড়ি, পঞ্চপল্লব, পঞ্চরত্ন, জল তথা গঙ্গাজল, মৃত্তিকা বা মাটি, নারিকেল বা ডাব, গামছা অথবা বস্ত্র, কান্ডকাঠি বা তীরকাঠি ইত্যাদি। এই প্রত্যেকটি উপকরণ বা উপাদান ব্যাবহার করার পেছনে রয়েছে সুনুর্দিষ্ট কারন।
ঘট স্থাপনের প্রথম পর্যায়ে পঞ্চগুড়ি দিয়ে পীঠ তৈরি করা হয়। এই পঞ্চগুড়ি হল ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ এবং ব্যোম তথা পঞ্চমহাভূতের প্রতীক। এই পঞ্চমহাভূতের উপর মৃত্তিকা দিয়ে পিঠ করা হয়। মৃত্তিকা বা মাটি দ্বারা সাধারনত গঙ্গার মাটিকে নির্দেশ করা হয়, তবে গঙ্গার মাটি সংগ্রহ করা সম্ভব না হলে কোন পবিত্র পুষ্করিণী অথবা কোন নদীর মাটি দিয়ে এই পীঠ নির্মান করা হয়ে থাকে।
দ্বিতীয় পর্যায়ে মৃত্তিকা দিয়ে নির্মিত বেদীর উপর পঞ্চশষ্য দেওয়া হয়। পঞ্চশষ্য আমাদের কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ ও মাৎসর্য্য এই পঞ্চবৃত্তির প্রতীক। যেহেতু পূজার ঘট মানুষের দেহের প্রতিরূপ, তাই এই পঞ্চবৃত্তি তার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। এছাড়াও এই মৃত্তিকা বেদীতে সামান্য ধান দুর্বা অর্পন করাও শাস্ত্রের বিধান। বেদীতে ধান দেওয়ার অর্থ শস্যপূর্ণা বসুন্ধরা ও দুর্বা প্রদান করার অর্থ সবুজ-শ্যামল ভূমি। আর এভাবে বেদী নির্মানের কাজ সম্পন্ন হয়।
এবার বেদীর উপর স্থাপিত হয় মুল ঘটটি। ঘট বসানোর সময় সিঁদুর দিয়ে অঙ্কিত হয় স্বস্তিকা চিহ্ন। ঘট সাধারণত মাটির বা পিতলের হওয়ার বিধান থাকলেও অভাবে স্টিলের ঘটও দেওয়া যেতে পারে। তবে যেহেতু মৃত্তিকা নির্মিত ঘট অগ্নিতে অবগাহন করার পর তার সমস্ত দোষ ত্রুটি দূরীভূত হয়, তাই মাটির ঘটকেই সর্বোত্তম বলে মনে করা হয়। এরপর ঘটের ভেতরে দেওয়া হয় পঞ্চরত্ন । পঞ্চরত্ন হচ্ছে আমাদের চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, ত্বক ও জিহ্বা এই পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের প্রতীক। ঘটের ক্ষেত্রে পঞ্চবৃত্তি যেমন প্রযোজ্য ঠিক তেমনি, পঞ্চ ইন্দ্রিয়ও প্রযোজ্য। এরপর ঘটে গঙ্গাজল ঢেলে পূর্ণ করা হয়। এখানে গঙ্গাজল হলো দেহরস অর্থাৎ রক্ত।
এবার ঘটের উপরে পঞ্চপল্লব দেওয়ার পালা। এখানে আম্র পল্লব ব্যাবহার করা শাস্ত্রের বিধান তবে এর অভাবে অশ্বত্থ, বট, পাকুড় ও যজ্ঞডুমুরের পাঁচটি পত্র ব্যাবহার করা হয় বিভিন্ন স্থানে। এই পঞ্চপল্লব পঞ্চবায়ু তথা পান, অপান, উদ্যান, সমান , এবং ব্যান এর প্রতীক । অন্যমতে ঘটের ওপর যে পঞ্চ পল্লব দেওয়া হয় তা হল গলা বা গ্রীবা। এই আমের পল্লব ভালোবাসা, ভ্রাতৃত্ববোধ, বৈশ্বিক বৈচিত্রতা ও উর্বরতার প্রতীক হিসেবে নির্দেশ করে। উল্লেখ্য পল্লবের প্রতিটি পত্রে সিঁদুরে ফোটা অঙ্কন করা হয়। এবার ঘটের উপর স্থাপন করা হয় শীষযুক্ত ডাব বা নারিকেল। আপনারা জানেন নারিকেলের আকৃতি অনেকটা মানুষের মুখমন্ডলের মত। খেয়াল করে দেখবেন নারিকেলের সূচালো অংশে তিনটি গোলাকার নকশা থাকে যা মূলত মানুষের দুই চোখ ও মুখকে প্রকাশ করে। যেহেতু নারিকেল আমাদের মুখমন্ডলের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ, তাই নারিকেলের মাধ্যমে ঘটের মুখমন্ডলের আকার দেওয়া হয়ে থাকে। পল্লবের মত নারিকেলেও পাঁচটি সিদুরের ফোঁটা অঙ্কন করা হয়।
মুখমন্ডল সৃষ্টির পর এবার আচ্ছাদনের পালা। মস্তক থাকলে তাতে আচ্ছাদন অবশ্যই দিতে হয়। তাই নারিকেলের উপর গামছা বা বস্ত্র অর্পন করা হয়।
বাকী রইল চারটি তীরকাঠি। এই চারটি তীরকাঠি লাল ধাগাসহকারে চারদিক দিয়ে বেষ্টন করে দেওয়া হয়। মুলত এগুলি চারটি বেদের প্রতীক হিসেবে স্থাপন করা হয়। এবং এভাবেই আমাদের দেহের প্রতিরূপ হিসেবেই তৈরি করা হয় ঘট। এবার ঘটের উপর পুষ্পমাল্য অর্পণ করে শুরু হয় দেব দেবীর পুজা।