অন্যান্য ২৪টি একাদশীর মত মোহিনী একাদশী ব্রত মাহাত্ম্য (Mohini Ekadashi Vrat Mahatmya) শ্রবণ, পঠন ও আলোচনায় শ্রীকৃষ্ণের অপার কৃপা লাভ করা যায়। “মোহ” শব্দটি থেকে উৎপন্ন হয়েছে “মোহিনী” শব্দটি। তাই মোহিনী একাদশী এ বিশ্ব সংসারের যাবতীয় মিছে মোহ-মায়া থেকে মুক্তি প্রদান করে জীবকে অপার আনন্দ দান করে। এই একাদশীর সাথেই জড়িয়ে আছেন ভগবান শ্রীবিষ্ণুর মোহিনী অবতার, সমুদ্র মন্থন, দেবতাদের অমৃত প্রাপ্তি এবং স্বর্গরাজ্যে পুনরায় দেবতাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার কাহিনী। তাই সকল বৈষ্ণবগনের কাছে মোহিনী একাদশী জগতের মায়া কাটিয়ে চিন্ময় ধামের প্রতি অগ্রসর হওয়ার একটি সুবর্ণ সুযোগ। তাই আসুন আমরাও শ্রবণ করি মোহিনী একাদশী ব্রত মাহাত্ম্য। সেই সাথে জেনে নেওয়া যাক, শ্রীবিষ্ণুর মোহিনী রূপের উৎপত্তি, মোহিনী একাদশী পালনের নিয়ম ও ব্রত পালনের ফলাফল সম্পর্কে।
মোহিনী একাদশী ব্রত মাহাত্ম্য
একদা এক স্নিগ্ধ প্রভাতে দেবরাজ ইন্দ্র তাঁর বাহন ঐরাবতের পীঠে আসীন হয়ে প্রাতভ্রমণ করছিলেন। পথিমধ্যে তাঁর সাথে সাক্ষাৎ ঘটে মহর্ষি দুর্বাসার। গজপৃষ্ঠের উপর আসীন উজ্জ্বল ও প্রভাময় ইন্দ্রকে দেখে আনন্দিত হলেন ঋষি দুর্বাসা। তিনি দেবরাজকে তাঁর আশির্বাদস্বরূপ একটি পুষ্পমাল্য প্রদান করলেন। কিন্তু দেবরাজ ইন্দ্র দুর্বাসার দেওয়া মালাখানির গুরুত্ব উপলব্ধি করতে না পেরে তাঁর বাহন ঐরাবতের শুড়ে সেটি স্থাপন করলেন। আর এতেই ঘটে গেল মারাত্মক এক অঘটন। দুর্বাসার উপহারকে অবজ্ঞা করে হস্তীকে অর্পণ করায় প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হলেন দুর্বাসা। তিনি ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে দেবরাজকে অভিশাপ দিলেন, “হে দেবরাজ ইন্দ্র, আমার দেওয়া আশির্বাদকে হেলা করে গুরুতর অপরাধ করেছ তুমি। এ অপরাধের ক্ষমা নেই। আমি তোমাকে অভিশাপ দিচ্ছি- খুব শীঘ্রই তোমার স্বর্গরাজ্যের পতন হবে।” দেবরাজের অনেক অনুনয় বিনয়ের পরেও দুর্বাসা তাঁর অভিশাপ বহাল রাখলেন এবং স্থান ত্যাগ করলেন।
দুর্বাসার অভিশাপে স্বর্গহারা দেবগন
আপনারা জানেন, মহর্ষি দুর্বাসার অভিশাপ বিফল হওয়ার নয়। ফলে, যা হওয়ার তাই হল। প্রবল পরাক্রমশালী ত্রিপুরাসুর স্বর্গরাজ্য আক্রমন করে দেবতাদেরকে যুদ্ধে পরাজিত করলেন। তারপর দেবগনকে বিতাড়িত করে স্বর্গরাজ্যের অধীশ্বর হয়ে বসলেন দেবসিংহাসনে। এদিকে, দেবতারা নিরুপায় হয়ে ছদ্মবেশ ধারন করে খুজতে লাগলেন পুনরায় স্বর্গরাজ্য ফিরে পাওয়ার উপায়। কিন্তু কোনভাবেই কোন উপায় খুঁজে পেলেন না তাঁরা। সবশেষে, তাঁরা শরণাপন্ন হলেন জগতের নাথ ভগবান শ্রীবিষ্ণুর। শ্রীবিষ্ণু দেবতাদের দুর্দশা শ্রবণ করে তাঁদেরকে একটিমাত্র উপায় প্রদর্শন করলেন। আর তা হল “অমরত্ব”।
সমুদ্র মন্থন
কিন্তু অমরত্ব অত সহজ কিছু নয়। কেবলমাত্র অমৃত পান করলেই অমরত্বের অধিকারী হওয়া যায়। কিন্তু দেবতারা অমৃত পাবেন কোথায়? এই সমস্যার সমাধানও প্রদান করলেন ভগবান শ্রীবিষ্ণু। তিনি দেবতাদেরকে পথ দেখালেন যে, ক্ষীরোদ সাগর মন্থন করলে অমৃতের কলস উত্থিত হবে, এবং সেই অমৃত পান করে দেবতারা অসুরদের বিরুদ্ধে জয়লাভ করতে পারবেন। কিন্তু সমস্যা হল, ক্ষীরোদ সাগর মন্থন করা যেন তেন ব্যাপার নয়। প্রবল শক্তি, সামর্থ্য, ও সময় প্রয়োজন হবে এই সমুদ্র মন্থন করতে। তাই দেবতারা কিছুটা শঠতার আশ্রয় নিয়ে সমুদ্র মন্থনে আহবান করলেন অসুরদের। অসুরগনও এক বিন্দু অমৃতের ফোঁটা পান করে অমর হওয়ার লোভে দেবতাদের সাথে সম্মিলিতভাবে সমুদ্র মন্থনে রাজি হলেন।
শ্রীবিষ্ণুর মোহিনী রূপ
অবশেষে সমুদ্র মন্থন করে উঠে এল সেই বহুল কাঙ্ক্ষিত অমৃতের কলস। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, এই অমৃত যদি দেবতাদের পাশাপাশি অসুরগনও পান করেন তাহলে তার পরিণতি কি হবে? ফলাফল সহজেই অনুমান করতে পারলেন দেবতারা। দেবাসুরের সংগ্রাম আরও তীব্র রূপ ধারন করবে, বারে বারে অসুরদের দ্বারা নিগৃহীত হবেন দেবগন, অসুরদের আসুরিক অত্যাচারে সমগ্র সৃষ্টি রসাতলে গমন করবে। তাহলে উপায়? উপায় একমাত্র ভগবান শ্রীবিষ্ণু, অনাদির আদি গোবিন্দ সর্বকারণকারণম। অসুরগণকে বিভ্রান্ত করতে তিনি এক অপরূপ লাবন্যময়ী, তথা লাস্যময়ী নারী রূপে আবির্ভূত হলেন অসুরগণের সম্মুখে। তাঁর আবেদনময়ী কায়া ও কমনীয় ইশারায় অসুরগন এতটা বিমোহিত হলেন যে তাঁরা অমৃতের কলসের কথা বেমালুম ভূলে গেলেন। আর এই সুযোগে অমৃতের কলসটিকে হস্তগত করে সমস্ত দেবতাদেরকে অমৃত পান করালেন মহাবিষ্ণু। জানেন কি ভগবান শ্রীবিষ্ণুর এই নারী রূপের নাম কি? হ্যাঁ, ইনিই সেই মোহিনী মূর্তি যাকে আমরা একাদশী তিথি হিসেবে পালন করি। এবং যে তিথিতে তিনি মোহিনী রূপ ধারন করেছিলেন সেই তিথিটিই হচ্ছে মোহিনী একাদশী তিথি।
শ্রীকৃষ্ণের বাণীতে মোহিনী একাদশী ব্রত মাহাত্ম্য
মোহিনী একাদশী ব্রত মাহাত্ম্য সুস্পষ্ট ও বিশদভাবে বর্ণিত হয়েছে কুর্মপুরাণে। এই পুরাণ মতে একদা পান্ডুপুত্র মহারাজ যুধিষ্ঠির ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কাছে প্রশ্ন করেছিলেন, “হে মাধব, বৈশাখ মাসের শুক্লপক্ষের একাদশী তিথির নাম কি, এ একাদশী পালনে কি কি ফল মেলে, কি প্রকার বিধিতে এই একাদশী পালন করতে হয় তা কৃপা করে আমাকে সবিস্তারে বলুন।” উত্তরে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বললেন, “হে ধর্মপুত্র, আপনার জ্ঞানতৃষ্ণা আমাকে অত্যাধিক সন্তুষ্ট করেছে। আপনি এখন যে প্রশ্নটি আমাকে করলেন, ঠিক একই প্রশ্ন ভগবান শ্রীরামচন্দ্রও তাঁর কুলগুরু বশিষ্ঠের কাছেও করেছিলেন। ” দশরথ নন্দন বশিষ্ঠদেবকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “হে গুরুবর, আমি আমার অর্ধাঙ্গিনী দেবী সীতার বিরহে অন্ত্যন্ত কাতর হয়ে পড়েছি। তাঁর অনুপস্থিতি আমার অন্তরকে প্রতিনিয়ত দগ্ধ করে চলেছে। হে গুরুদেব, এমন একটি উত্তম ব্রতের ব্রতকথা আমাকে বলুন যার মাধ্যমে স্বর্বপাপ ক্ষয় হয়, সর্বদুঃখ বিনাশ হয় এবং সকল মোহ মায়া থেকে পরিত্রান মেলে।”
আরও পড়ুনঃ একাদশী কী? কিভাবে একাদশী আবির্ভাব হলো, একাদশী পালনের নিয়মাবলী, একাদশী মাহাত্ম্য
উত্তরে ঈষৎ হাস্য করে বশিষ্টদেব বললেন, ” হে দশরথনন্দন, শুধুমাত্র রাম নামেই অজস্র পাপ নাশ হয়, অপরিমেয় দুঃখ দূরীভূত হয় এবং রাশি রাশি মোহ-মায়াজাল থেকে মুক্ত হওয়া যায়। কিন্তু তোমার প্রশ্নটি জগতের অন্যান্য জীবের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হতে পারে, তাই আমি এর উত্তর প্রদান করছি। “
এই বলে সুর্যবংশের কুলগুরু ভগবান বশিষ্ঠ বলতে শুরু করলেন- ” বৈশাখ মাসের শুক্ল পক্ষের একাদশী তিথিটি মোহিনী একাদশী নামে জগতে প্রসিদ্ধ। এই ব্রত সঠিকভাবে পালন করলে মায়ার সংসারের ভ্রমিত জীবের সকল পাপ, দুঃখ ও মোহ-মায়াজাল অঙ্কুরে বিনষ্ট হয়। তাই সকল মনুষ্যগণের উচিত সকল পাপক্ষয়কারী, সর্বদুঃখবিনাশী ও সর্ব মায়াজাল ছিন্নকারী এই একাদশী ব্রত সঠিকভাবে ও নিষ্ঠার সাথে পালন করা। একাগ্রচিত্তে এখন তুমি এই মোহিনী একাদশীর ব্রত মাহাত্ম্য ও মহিমা শ্রবণ কর, তোমার সকল দুঃখ দূর হবে।
মহাপবিত্র সরস্বতী নদীর অববাহিকায় অপার সৌন্দর্যের এক সুশোভনা নগরী ছিল। নগরীর নাম ছিল ভদ্রাবতী এবং সেই নগরীরতে রাজত্ব করতেন চন্দ্রবংশীয় রাজা ধৃতিমান। সেই একই নগরীতে ধনপাল নামক একজন বৈশ্যও বসবাস করতেন।এই ধনপাল ছিলেন পুণ্যকর্মা ও সমৃদ্ধশালী ব্যক্তি। তিনি নলকূপ নির্মান, জলাশয় খনন, উদ্যান পরিচর্যা, মঠ ও গৃহ নির্মাণ ইত্যাদি কার্য অন্যন্ত নৈপুণ্যের সাথে করতে পারতেন। পাশাপাশি তিনি ছিলেন পরম বিষ্ণুভক্ত ও শান্তিপ্রিয় প্রকৃতির মানুষ। ভগবান বিষ্ণুর আশির্বাদে তিনি পাঁচ পুত্রের পিতা হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন। তাঁর প্রথম চার পুত্র ছিল সচ্চরিত্র, কর্মঠ, ধার্মিক এবং সংসারী।
কিন্তু সমস্যা হল পঞ্চম পুত্র ধৃষ্টবুদ্ধিকে নিয়ে। ধনপালের এই পুত্রটি ছিল অতিশয় দুরাচারী। হেন কোন পাপকার্য ছিল না যা সে করত না। পরনারী সম্ভোগ, গণিকালয়ে যাতায়াত, লাম্পট্য ও দ্যুতক্রীড়াসহ বিবিধ রকমের পাপকার্যে সে প্রতিনিয়ত মত্ত ছিলেন তিনি। দেব-দেবীর প্রতি ভক্তি, ব্রহ্মণ সেবা বা পিতামাতার প্রতি যাবতীয় কর্ত্তব্যে তিনি একেবারেই বিমুখ ছিলেন। দিনের পর দিন অন্যায়কার্য সংগঠন, দুষ্ট কর্মকাণ্ড ও পিতার অর্জিত সম্পদের অপব্যাবহার করে পশুতুল্য হয়ে উঠেছিলেন ধৃষ্টবুদ্ধি। এছাড়াও অভক্ষ ভক্ষণ ও মদিরাপানের মত কুঅভ্যাস তো ছিলই।
একদিন তাঁর পিতা ধনপাল তাঁর বৈশ্যসুলভ কর্মের খোঁজে নগরীতে ভ্রমন করছিলেন। হঠাৎ তাঁর দৃষ্টিপাত হল তাঁর দুরাচারী পুত্রের প্রতি। তিনি দেখতে পেলেন তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র ধৃষ্টবুদ্ধি এক গণিকার কাঁধে হাত রেখে নিঃসকোচে সমস্ত নগরী ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এই নির্লজ্জ পুত্রের এমন অপকর্ম নিজ চোখে দর্শন করে তিনি লজ্জায় ও অপমানে অত্যন্ত মর্মাহত হলেন। এরপর ধৃষ্টবুদ্ধি গৃহে ফিরে এলে তিনি পুত্রের এই কুস্বভাবের কারনে তাঁকে গৃহ থেকে বহিষ্কার করে দিলেন। এরপর তাঁর পিতার মত ধৃষ্টবুদ্ধির নিকট আত্মীয়-স্বজনও তাকে পরিত্যাগ করল। অগত্যা জীবিকা নির্বাহ করার তাগিদে অলংকারাদি বিকিকিনি করে দিন কাটতে লাগল ধৃষ্টবুদ্ধির। কিন্তু এভাবে আর কতদিন চলে? একসময় প্রবল অভাব এবং অর্থকষ্টের সম্মুখীন হলেন তিনি। তাঁর সেই ধনহীন অবস্থা দেখে তাঁর কুসঙ্গী গণিকারাও একে একে তাঁকে পরিত্যাগ করে চলে গেল।
আরও পড়ুনঃ একাদশীর উপবাস-দিন নির্ণয়-বিভ্রান্তি ও সমাধান
একদা অর্থের অভাবে অন্নবস্ত্রহীন এবং ছিন্নমূল অবস্থায় ক্ষুধা-তৃষ্ণায় কাতর হয়ে পড়লেন ধৃষ্টবুদ্ধি।এরপর উপায়ান্তর না দেখে চুরি করা শুরু করলেন তিনি। কৃষকের মাঠ থেকে ফলমূল ও অন্যান্য আহারাদি চুরি করে জীবন ধারন করতে লাগলেন তিনি। একদিন তিনি চুরি করার সময় হাতে নাতে ধরা পড়লেন রাজপ্রহরীদের হাতে। কিন্তু তাঁর সম্মানিত পিতার সম্মানার্থে প্রহরীগন তাকে মুক্ত করে দিলেন। এভাবে বেশ কিছুবার চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়েও চৌর্যবৃত্তি বন্ধ হল না তাঁর। দিনের পর দিন তাঁর এমন উৎপাতে বিরক্ত হয়ে একসময় রাজাও তাকে কারাগারে নিক্ষেপ করলেন। কারাগারে তাঁকে কষাঘাত করার দন্ডাদেশও দিলেন রাজা ধৃতিমান। কিছুকাল কারাবাস ভোগ করে চুরি ত্যাগ করলেন ধৃষ্টবুদ্ধি। তবে এবার তিনি মেতে উঠলেন বনের নিরীহ পশুপাখি নিধনে এবং নির্বিচারে তাঁদের মাংস ভক্ষণে। আর এভাবে পাপের পঙ্কিল পথে পদচারনা বাড়তে লাগল দুষ্টমতি ধৃষ্টবুদ্ধির।
কিন্তু পাপকার্য কখনোই সুখ বয়ে আনে না। তাই দিবারাত্রি দুঃখশোকে জর্জরিত হয়ে ভীষণ দুঃখযন্ত্রণা ভোগ করতে লাগলেন ধৃষ্টবুদ্ধি। এক পর্যায়ে পাপের ঘোর অমানিশায় ডুবন্ত অবস্থায় কোন একদিন তিনি কৌন্ডিন্য ঋষির কুটিরে উপস্থিত হলেন। তখন বৈশাখ মাস। ঋষিবর কৌন্ডিন্য গঙ্গাস্নান করে তাঁর ছোট্ট আশ্রম কুটিরের দিকে প্রত্যাবর্তন করছিলেন। আর কুটিরের পাশেই শোকাকুল ধৃষ্টবুদ্ধি তাঁর পাপগ্রস্থ জীবনের হিসাব নিকাশ মেলাচ্ছিলেন। এমন সময় দৈব ইঙ্গিতে ঋষির ভেজা বস্ত্র থেকে এক বিন্দু জল তাঁর পাপী শরীরে পতিত হল। সহসা তাঁর শরীরের প্রত্যেক প্রান্তে যেন বিদ্যুৎ প্রবাহের মত শিহরণ জাগল। এবং সেই মূহুর্তেই ঋষির শরীরের পবিত্র জলের স্পর্শে তাঁর অতীতের সমস্ত পাপ দূরীভূত হল।
ধৃষ্টবুদ্ধি তখন ষষ্টাঙ্গে লুটিয়ে পড়লেন কৌন্ডিণ্য ঋষির পদযুগলের উপর। প্রার্থনা করতে লাগলেন, “হে ঋষিবর, পাপের পঙ্কিল পথে চলতে চলতে এই পৃথিবীতেই নরক যন্ত্রনা ভোগ করছি আমি। কৃপা করে আমার এই ভীষণ দুঃখযন্ত্রণা থেকে মুক্তিলাভ করার উপায় বলুন। ” ঋষি কৌন্ডিণ্য স্মিত হেসে তুলে ধরলেন ধৃষ্টবুদ্ধিকে। তারপর স্নিগ্ধ সুরে বললেন, “হে বৎস, এখন বৈশাখ মাস, এ মাসের শুক্লপক্ষের একাদশী তিথিতে মোহিনী একাদশী পালিত হবে। তুমি এই মহাপূন্যদায়িনী ও সর্বপাপ ক্ষয়কারী ব্রত পালন কর। এই ব্রত নিষ্ঠার সাথে পালন করলে জীবের বহু জন্মের সঞ্চিত বিপুল পরিমান পাপরাশি নিমেষেই বিনষ্ট হয়। ” কৌন্ডিণ্য ঋষির দেখানো পথে মোহিনী একাদশী ব্রত মাহাত্ম্য শ্রদ্ধার সাথে শ্রবণ এবং নিষ্ঠার সাথে পালন করলেন দূর্মতি ধৃষ্টবুদ্ধি। এই একাদশী ব্রত প্রভাবে তাঁর সমস্ত পাপ দূর হল, এবং সমস্ত বন্ধন ছিন্ন হল। অতঃপর একদিন তিনি দিব্যদেহ ধারন করে এবং গরুড়ে আরোহন করে বৈকুন্ঠলোকে গমন করলেন।
মোহিনী একাদশী পালনের ফল
ধৃষ্টবুদ্ধির আখ্যান বর্ণনা করার পর কুলগুরু বশিষ্ঠ ভগবান শ্রী রামচন্দ্রকে আরও বললেন, “হে কৌশল্যানন্দন, এই ত্রিলোকে মোহিনী একাদশী ব্রতের চেয়ে উত্তম কোন ব্রত আর নেই। বহুবিধ যাগ-যজ্ঞ করা, তীর্থস্থান দর্শন করা, এবং বহুমূল্য দ্রবাদি দান করলেও মোহিনি একাদশী ব্রত পালনের মত ফল অর্জিত হয় না। এছাড়াও মোহিনী একাদশী ব্রত মাহাত্ম্য, মহিমা ও ব্রতকথা শ্রবণ এবং কীর্তন করলে সহস্র গোদানের ফল লাভ হয়।
মোহিনী একাদশী ব্রত পালনের বিধি বা নিয়মঃ
মোহিনী একাদশী ব্রত মাহাত্ম্য বর্ণনায় আরও বলা হয়েছে মোহিনী একাদশী ব্রতের পুন্যতিথিতে প্রভাতকালে তিল এবং কুশ নিয়ে গঙ্গাস্নান করে এবং শুদ্ধবস্ত্র পরিধান করে এই একাদশী ব্রত পালনের সঙ্কল্প করতে হয়। বিষ্ণুমূর্তি, শালগ্রাম শীলা বা শ্রীকৃষ্ণের ছবির সম্মুখে প্রদীপ প্রজ্বলন করে, পুষ্প-চন্দন ও তিল-ফল ভগবানকে অর্পণ করার বিধান। একাদশীর সাধারন নিয়মাবলি তথা পঞ্চরবিশস্য বর্জন, নেশাজাতীয় দ্রব্য ত্যাগ করা এবং মৈথুন থেকে বিরত থাকার পাশাপাশি মোহিনী একাদশীতে সারাদিন ভগবান শ্রীবিষ্ণুর নামগান ও মহিমা সংকীর্তন, শ্রবণ এবং আলোচনা করাও শাস্ত্রের বিধান। এবং পরের দিন তথা পারণের দিনে ব্রাহ্মণদেবকে সাধ্যমত দান করে মোহিনী একাদশী ব্রত এবং উপবাস ভঙ্গ করতে হয়।
আরও পড়ুনঃ
পান্ডবা নির্জলা একাদশীর মাহাত্ম্য
শ্রাবণ পুত্রদা (পবিত্রারোপণী) একাদশী ব্রতের মাহাত্ম্য
অজা বা অন্নদা একাদশীর ব্রত মাহাত্ম্য [রাজা হরিশ্চন্দ্রের কাহিনী ]
পদ্মা/পরিবর্তনী/পার্শ্ব একাদশী ব্রত মাহাত্ম্য
পাশাঙ্কুশা (পাপাঙ্কুশা) একাদশী ব্রত মাহাত্ম্য
উত্থান একাদশী (প্রবোধিনী) ব্রত মাহাত্ম্য
পৌষ পুত্রদা একাদশী ব্রত মাহাত্ম্য
‘ভৈমী’ বা ‘জয়া’ একাদশী কি? ভৈমী একাদশীর মাহাত্ম্য
পাপমোচনী একাদশীর ব্রত মাহাত্ম্য
সনাতনের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও শেকড়ের সন্ধান জানতে আমাদের সাথে ফেসবুক ও ইউটিউবে যুক্ত হতে পারেন।