রথ শব্দটি সংস্কৃত ধাতুমূল ‘র’-এর সঙ্গে ‘ঘস্’ প্রত্যয়যোগে নিষ্পন্ন। ‘র’ ধাতুর অর্থ এক স্থান থেকে অন্যস্থানে স্থানান্তর। অর্থাৎ, রথ শব্দটির অর্থ দাঁড়ায়, যার মাধ্যমে এমন এক স্থান থেকে অন্য স্থানে গমন করা যায় এমন যানবিশেষ। কিন্তু যে রথদ্বারা ভগবান জগন্নাথ ভ্রমণ করেন তা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এটি কোনো সাধারণ যানবাহন নয়, কারণ, কেউ ভগবানকে বহন করতে পারে না- ভগবান স্বয়ং নিজেকে বহন করেন। অর্থাৎ, তিনি তাঁর নিজের সন্ধিনী শক্তির দ্বারা বাহিত হন। ভগবানের অন্তরঙ্গা শক্তি অথবা স্বরূপ শক্তির তিনটি ভাগ রয়েছে:
১। হ্লাদিনী বা আনন্দদায়িনী শক্তি;
২। সন্ধিনী বা অস্তিত্ব সম্বনন্ধীয় শক্তি এবং
৩। সম্বিৎ বা সমগ্র-জ্ঞান বাচক শক্তি।
সন্ধিনী শক্তিই ভগবানকে বহন করে। শ্রীমতি রাধারাণী যেমন ভগবানের হ্লাদিনী শক্তির প্রকাশ, তেমনি নন্দ, যশোদা এবং দেবকী হচ্ছেন তাঁর সন্ধিনী শক্তির প্রকাশ। তারা ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে বহন করেন, এই সন্ধিনী শক্তি ধারণকারী শক্তি নামেও পরিচিত।
এ সূত্রে, জগন্নাথদেবের রথ যেহেতু তাঁকে বহন করছে, তাই রথ হচ্ছে ভগবানের অন্তরঙ্গা শক্তি বা স্বরূপ শক্তির অন্তর্গত সন্ধিনী শক্তির প্রকাশ। এই সন্ধিনী শক্তি বা স্বরূপ শক্তিই রথ আকারে ভগবানকে বহন করে। চৈতন্যচরিতামৃতের আদি লীলায় (৪/৬৪) বলা হয়েছে-
“সন্ধিনীর সার অংশ- “শুদ্ধসত্ত্ব” নাম।
ভগবানের সত্ত্বা হয় যাহাতে বিশ্রাম।”
সন্ধিনী শক্তির সার অংশ হচ্ছে শুদ্ধসত্ত্ব এবং ভগবান কৃষ্ণের সত্ত্বার বিশ্রাম হয় এর উপরে। কৃষ্ণের মাতা, পিতা, বাড়ি, বিছানাপত্র, আসন এবং অনেক কিছু শুদ্ধসত্ত্বে রূপান্তরিত হয়। ভগবান যখন রথে আসীন হন, তিনি আরো বেশি কৃপালু হন।
রথে তু বামন দৃষ্ট্বা পুনর্জন্ম ন বিদ্যতে।
“ভগবান বামনদেবকে রথে দর্শন করলে, কারো পুনর্জন্ম হয় না।” (সূত-সংহিতা)
রথযাত্রার ইতিহাস
‘রথ’ শব্দটির ব্যবহার অতি প্রাচীন, যা প্রাচীন শাস্ত্রসমূহ যেমন ঋগবেদ এবং অথর্ব বেদে পাওয়া যায়। আমাদের দেহটিও রথ নামে পরিচিত। শ্রীমদ্ভগবদগীতা যথাযথ (৬/৩৪)- এর তাৎপর্যে শ্রীল প্রভুপাদ কঠোপনিষদ থেকে নিম্নোক্ত ২টি শ্লোক উল্লেখ করেছেন-
আত্মানং রথিনং বিদ্ধি শরীরং রথমেব তু।
বুদ্ধিং তু সারখি বিদ্ধি মনঃ প্রগ্রহমেব চ।।
ইন্দ্রিয়ানি হয়নাহর্বিষয়াংস্তেষু গোচরান্।
আত্মেন্দ্রিয় মনোযুক্তং ভোক্তেত্যাহর্মনীষিণঃ।।
“এই দেহরূপ রথের আরোহী হচ্ছে জীবাত্মা, বুদ্ধি হচ্ছে সেই রথের সারথি। মন হচ্ছে তার বলগা এবং ইন্দ্রিয়গুলি হচ্ছে ঘোড়া। এভাবেই মন ও ইন্দ্রিয়ের সাহচর্যে আত্মা সুখ ও দুঃখ ভোগ করে। চিন্তাশীল মনীষীগণ এভাবেই চিন্তা করেন।”
রথের সাধারণ অর্থ যানবিশেষ। প্রাচীন যুগে যোদ্ধাগণ শক্তিশালী রথগুলো চালাতেন তাদের শত্রুদের ওপর বিজয় লাভের জন্য। সূর্যদেবও একটি রথমধ্যে আরোহণ করে আকাশমার্গে পরিভ্রমণ করেন। ভবিষ্যপুরাণ অনুসারে, সূর্যদেবের জন্য ভাদ্র মাসে (আগস্ট-সেপ্টেম্বর) একটি রথ অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। ভারতবর্ষে সূর্যদেবের জন্য আরো একটি রথযাত্রা হয় মাঘ (জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি) মাসে শুক্লপক্ষের সপ্তমী তিথিতে।
বিভিন্ন পুরাণ, যেমন পদ্মপুরাণ এবং স্কন্দপুরাণ অনুসারে, বিষ্ণুভক্তগণ রথযাত্রা উদযাপন করেছিলেন চার্তুমাস্যের শেষদিকে শুক্লপক্ষের দ্বাদশীতে (শুক্লপক্ষের ১২ তম দিন) কার্তিক মাসে (অক্টোবর-নভেম্বর)। তারা ভগবান বিষ্ণুর একটি বিগ্রহ রথে স্থাপন করে অনেক জাঁকজমকপূর্ণভাবে রথ টানতেন।
শ্রীল মধ্বাচার্য কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ভারতের প্রসিদ্ধ মন্দির উড়ুপিতে শ্রীশ্রীকৃষ্ণবলরামের একটি রথ অনুষ্ঠিত হয়।
শিবভক্তগণ দেবাদিদেব মহাদেবের জন্য একটি রথ করেন শুক্লপক্ষের অষ্টমীতে চৈত্র মাসে এবং নেপালে বৈশাখ মাসের ১ম এবং ২য় দিন একটি রথ করেন ভৈরব এবং ভৈরবীর (শিব এবং পার্বতী) জন্য।
দেবী পুরাণ অনুসারে, মহাদেবীর জন্য ভক্তগণ একটি রথযাত্রা উদযাপন করে কার্তিক মাসে, শুক্লাতৃতীয়া থেকে পঞ্চমী পর্যন্ত এবং সপ্তমী থেকে একাদশী, সেই সাথে পূর্ণিমা পর্যন্ত।
কোনো কোনো পন্ডিত বলেন, বৌদ্ধধর্মালম্বীগণ কর্তৃক একটি রথযাত্রা সিংহলে (শ্রীলঙ্কা) উদযাপিত হয়। তারা শহরের রাজপথে জাঁকজমকপূর্ণভাবে পরিভ্রমণ করেন এবং একটি মাচার উপর হাতির দাঁত স্থাপন করে ৬ দিন ধরে অনুষ্ঠান উদযাপন করেন।
এভাবে রথের ধারণা এবং রথযাত্রার রীতি প্রাচীন ইতিহাসে এবং বিভিন্ন ধর্মগোষ্ঠীতে পাওয়া যায়। ভারতের উড়িষ্যা রাজ্যের অন্তর্গত পুরোষোত্তম ক্ষেত্র পুরীধামে শ্রীজগন্নাথমন্দিরে বিভিন্ন উৎসব পালন করা হয়। তার মধ্যে ১২টি গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান রয়েছে, যেগুলোকে দ্বাদশ-যাত্রা বলা হয়। সেই উৎসবগুলো নিম্নরূপ:
১। দেব-স্নান-পূর্ণিমা,
২। শ্রীগুন্ডিচা যাত্রা (রথযাত্রা),
৩। হরি শয়ন,
৪। দক্ষিণায়ন অথবা কর্কট সংক্রান্তি,
৫। পার্শ্ব-পরিবর্তন,
৬। উত্থান একাদশী,
৭। ওড়ন-ষষ্ঠী,
৮। পুষ্যাভিষেক,
৯। উত্তরায়ণ অথবা মকর সংক্রান্তি,
১০। দোল উৎসব,
১১। দমনক-চতুর্দশী এবং
১২। অক্ষয় তৃতীয়া বা চন্দন-যাত্রা।
এসমস্ত উৎসবের মধ্যে রথযাত্রা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। বিভিন্ন বৈদিক শাস্ত্র অনুসারে, রথযাত্রা ঘোষ-যাত্রা, নব-দিন-যাত্রা, দশাবতার যাত্রা, গুন্ডিচা মহোৎসব এবং আদপ যাত্রা নামেও পরিচিত।
পুরীর জগন্নাথদেবের রথযাত্রা কেবল ভারতবর্ষেেই নয়, সমগ্র পৃথিবীর মধ্যে অনন্য। জগন্নাথদেব, বলদেব ও সুভদ্রা মহারাণীকে যখন শ্রীমন্দির থেকে বের করে সুবৃহৎ সুসজ্জিত রথে স্থাপন করা হয়, তখন প্রভুকে দর্শন করার জন্য ও তাঁর প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদনের জন্য লক্ষ লক্ষ লোক সেখানে জমায়েত হয়।
এমনকি সপ্তদশ শতকের দিকে Juggernaut নামে একটি শব্দ ইংরেজি ভাষায় প্রচলিত হয়েছে, যা জগন্নাথ শব্দ থেকে এসেছে। আপনি যদি রথযাত্রার কথা উল্লেখ করেন, তখন পুরীর অধিবাসীগণ তাৎক্ষণিকভাবে জগন্নাথদেবের রথকেই কল্পনা করে থাকেন। কখন পুরীর রথযাত্রা শুরু হয়েছিল তা বলা কঠিন। গবেষকমন্ডলী এবং ইতিহাসবিদগণের রথযাত্রার উৎপত্তি সম্পর্কে বিভিন্ন শাস্ত্র থেকে ভিন্ন ভিন্ন তথ্য পেয়েছি।
‘মাদলা পঞ্জি’ নামে ষোড়শ শতাব্দীতে প্রণীত এক পঞ্জিকায় উল্লেখ আছে, একদা জগন্নাথ মন্দির এবং গুন্ডিচা মন্দিরের মধ্যে মালিনী নামে একটি নদী ছিল যা বড় নাই অথবা বড় নদী নামেও খ্যাত।
সে সময়ের রাজা ৬টি রথ নির্মাণ করেন। সুদর্শন চক্রসহ জগন্নাথ এবং বলরাম ও সুভদ্রার বিগ্রহের জন্য তিনটি রথ নদী পর্যন্ত আনতে ব্যবহৃত হতো। তারপর বিগ্রহগণ নদীর অপর প্রান্তে আনা হলে, সেই স্থান থেকে জগন্নাথ, বলরাম এবং সুভদ্রাকে গুন্ডিচা মন্দিরে আনতে তিনটি অতিরিক্ত রথ নিযুক্ত করা হতো। রাজা বীর নরসিংহের (১২৩৮-১৩৬৪) শাসনামলে নদীটি মাটি দ্বারা পূর্ণ বরা হয় এবং তারপর থেকে গুন্ডিচা মন্দির পর্যন্ত যাওয়ার জন্য শুধু তিনটি রথ প্রয়োজন হয়, আধুনিক হিসাব অনুসারে সেটি প্রায় ২.৮ কিলোমিটার।
মাদলা পঞ্জি অনুসারে গুন্ডিচা মন্দিরটি পূর্বে নরসিংহ এটি পাথর দিয়ে পুননির্মাণ করেন। কিন্তু যখন পুরীর রথযাত্রা শুরু হয়, এর কোনো সঠিক তথ্য নেই। তবে, ক্রয়োদশ শতাব্দীতে যে রথযাত্রা উদযাপিত হতো তার ঐতিহাসিক প্রামাণ রয়েছে।
‘রথ চকড়’ নামে একটি গ্রান্থ প্রাচীন মন্দিরে পাওয়া যায়। এটি প্রতিপন্ন করে যে, রাজা যযাতি কেশরী ৮ম শতাব্দীতে রথযাত্রা উদযাপন করেন।
স্কন্দপুরাণ অনুসারে, মহারাজ ইন্দ্রদ্যুম্নের শাসনামলে রথযাত্রা উদযাপিত হয়, যখন তিনি জগন্নাথ, বলরাম এবং সুভদ্রা বিগ্রহ স্থাপন করেন।
স্বরণায় সুগতিতাম সাধু রথ-ক্রয়ম অলঙ্কারম্
দুকূল-রত্ন-মালাদয়র বহু-মূল্যয়র বৃষাম্ মহৎ।
নারদমুনি বললেন, “প্রিয় রাজা, ভগবানের ভ্রমণের জন্য সুন্দরভাবে সজ্জিত তিনটি রথ প্রস্তুত করতে হবে। এই রথ গুলো রত্ন, অলঙ্কার, পাটের শাড়ি, মালা এবং বিভিন্ন মূল্যবান রত্নদ্বারা আবৃত করতে হবে। (স্কন্দপুরাণ, বৈষ্ণব খন্ড, পুরুষোত্তম-ক্ষেত্র-মহাত্ম্য, ২৫.৭)
শ্রী-বাসুদেবস্য রথো গরুড়-ধ্বজ চিহ্নিত
পদ্ম-ধ্বজ সুভদ্রায়া রথ-মূর্ধানী ধার্যতাম্।।
ভগবান বাসুদেবের রথ গরুড় ধ্বজ- (গরুড় প্রতীকসহ একটি পতাকা) সুভদ্রার রথ পদ্মধ্বজ (পদ্মফুলের প্রতীক সমৃদ্ধ পতাকা।) ’(স্কন্দপুরাণ বৈষ্ণব খন্ড, পুরুষোত্তম-ক্ষেত্র মাহাত্ম্য, ২৫.৯)
“তাল বৃক্ষ ভূতলে ঊর্ধ্বমূখী হয়ে দন্ডায়মান থাকে বলে এর এরূপ নামকরণ করা হয়েছে (অর্থাৎ, তল শব্দটি থেকে তাল নামের উৎপত্তি) এই তালবৃক্ষ ভগবান বলরাম ও তাঁর প্রকাশ অনন্তশেষের প্রতীক। বলরামজীর রথে তালবৃক্ষের প্রতীক সম্বলিত একটি ধ্বজ (পতাকা) স্থাপন করা হয়। এজন্য বলরামের রথ তালধ্বজ নামে পরিচিত। (স্কন্দ পুরাণ, বৈষ্ণব খন্ড, পুরুষোত্তম ক্ষেত্র মাহাত্ম্য- ২৫/১৪-১৫)
স্কন্দ পুরাণে আরো বর্ণিত আছে যে, স্বর্গের স্থপতি বিশ্বকর্মা নারদ মুনি কর্তৃক নির্দেশিত হয়ে একই দিনে তিনটি রথ নির্মাণ করেন। তখন নারদ মুনি বৈদিক রীতি অনুসারে রথসমূহ স্থাপন করেন। এই বর্ণনা হতে আমরা জানতে পারি, রথযাত্রা সুপ্রাচীনকাল থেকে প্রচলিত- হরেকৃষ্ণ