কথায় বলে অর্থ, খ্যাতি ও ক্ষমতা মানুষকে সবকিছুই পাইয়ে দিতে পারে। কিন্তু এর পুরোপুরি ব্যাতিক্রম পুরীর জগন্নাথ মন্দির। নিবিড় অলৌকিক রহস্যের মায়াজালে ঘেরা এই প্রাচীন মন্দির যেমন জগদ্বিখ্যাত, তেমনি এ মন্দির নিয়ে প্রচলিত রয়েছে কিছু অমীমাংসীত বিতর্কও। ঠিক তেমনি এক বিতর্ক হচ্ছে এই মন্দিরে কোন অহিন্দু প্রবেশ করতে পারে না। কবে কখন ও কার দ্বারা এই নিয়মের উদ্ভব হয়েছে তা স্পষ্টভাবে জানা না গেলেও, এই রীতি যে অত্যন্ত প্রাচীন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। যাইহোক, আজ আমরা এমন ১০ জন ব্যাক্তিকে নিয়ে কথা বলতে চলেছি যারা নিজদের কৃতকর্ম দ্বারা সারা বিশ্বব্যাপী খ্যাতি অর্জন করলেও জগন্নাথ মন্দিরের দ্বার থেকে তাঁদেরকে ফিরে যেতে হয়েছিল খালি হাতে। অর্থাৎ এই ১০ জন প্রভাবশালী ব্যাক্তিও প্রবেশ করতে পারেননি সুপ্রাচীন পুরীর মন্দিরে। আপনি শুনে আশ্চর্য হবেন এই ১০ জনের তালিকায় রয়েছেন রবীন্দ্রনাথ, গুরু নানক, ইন্দিরা গান্ধী, মহাত্মা গান্ধী থেকে শুরু করে ইসকনের প্রতিষ্ঠাতা শ্লীল প্রভুপাদও। আসুন তাহলে বিস্তারিতভাবে জেনে নেওয়া যাক এই বিখ্যাত ১০ ব্যাক্তি কারা এবং কি কারনে এদেরকে পুরী মন্দিরে ঢুকতে বাঁধা দেওয়া হয়েছিল।
১. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। অতুল্য প্রতিভাবান, এশিয়ার প্রথম নোবেল বিজয়ী এবং বিপুল বিত্তশালী জমিদার পরিবারের সন্তান ছিলেন এই ক্ষণজন্মা কবি ও সাহিত্যিক। তাঁর সঙ্গে ওড়িশার সম্পর্কও ছিল দীর্ঘদিনের। বস্তুত ওই রাজ্যেও জমিদারির অংশ ছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতামহ জমিদার দ্বারকানাথ ঠাকুরের। সেই জমিদারির পরিদর্শনে বারবার পুরী যেতে হত রবীন্দ্রনাথকে। কিন্তু এতবার সেখানে গেলেও পুরীর মন্দিরে ঢোকা হয়নি তাঁর। কি আশ্চর্য হচ্ছেন? জানেন কি তাঁকে পুরী মন্দিরে ঢুকতে না দেওয়ার কারন কি? আসলে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন ব্রাহ্ম ধর্মের অনুসারী অর্থাৎ নিরাকারের উপাসক। তার উপর ঠাকুর বংশের পিরালি ব্রাহ্মণত্বের বিতর্কও ছিল আরেকটা কারন। এই সব কারণেই পুরীর মন্দিরে ঢোকার অনুমতি পাননি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
২. গুরু নানক
আপনারা অনেকেই গুরু নানকের নাম শুনে থাকবেন। জন্মসূত্রে তিনি সনাতন ধর্মাবলম্বী হলেও পরবর্তীতে তিনি শিখ ধর্মের প্রবর্তন করেন এবং বহু স্থানে ভ্রমণ করে মানুষের মধ্যে এক ঈশ্বরের মতবাদ প্রচলন করেন। গুরু নানক ১৫০৮ সালে তার অহিন্দু শিষ্য মর্দানাকে নিয়ে পুরীতে এসেছিলেন জগন্নাথ দেবের দর্শন লাভের আশায়। কিন্তু মন্দিরের তৎকালীন পান্ডারা তাঁর শিষ্যকে ইঙ্গিত করে তাঁকে জগন্নাথ মন্দিরে প্রবেশ করতে বাঁধা দেন।
স্থানীয় লোককথা অনুসারে, গুরু নানক মন্দিরে প্রবেশ করতে না পেরে সন্নিকটে অবস্থিত পুরী সমুদ্র তটে গমন করেন এবং তিনি সেখানে জগন্নাথদেবের প্রার্থনায় বসেন। মন্দিরে না ঢুকতে পেরে প্রসাদ বঞ্চিত হয়ে অভুক্ত অবস্থায় কাটাতে লাগলেন তাঁরা। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে সন্ধ্যাবেলায় এক রহস্যময় ব্যাক্তি এসে সোনার থালায় অপ্রতুল খাবার ও সুস্বাদু জল পরিবেশন করে দিলেন তাঁদের জন্য। পরবর্তী দিন যখন পূজারীগন জগন্নাথকে জাগ্রত করতে গেলেন তখন সকলে দেখলেন জগন্নাথের সোনার থালা আর সেখানে নেই। আবার সেদিনই পুরীর রাজা স্বপ্নে দেখলেন স্বয়ং জগন্নাথদেব পুরী সমুদ্রের সৈকতে গিয়ে এক সাধুকে প্রসাদ দিচ্ছেন। তাই পূজারীগণ যখন হন্যে হয়ে গগন্নাথ দেবের সোনার থালা খুজছিলেন, তখন রাজা হাসিমুখে চলে গেলেন সমুদ্র সৈকতে। সেখান থেকে তিনি উদ্ধার করলেন জগন্নাথ দেবের সোনার থালা এবং সেই সাথে গুরু নানককে অনুরোধ করলেন মন্দিরে ঢুকে জগন্নাথ দেবের পবিত্র বিগ্রহ দর্শন করার জন্য। গুরু নানক রাজার অনুরোধে মন্দির পরিদর্শন করে রাজাকে বলেছিলেন, “জগন্নাথ দেব শুধুমাত্র পুরীর ভগবান নন, তিনি সকলের ভগবান।” আর সেই থেকেই হিন্দুদের পাশাপাশি শিখ ধর্মের অনুসারীদেরও প্রবেশাধিকার প্রতিষ্ঠিৎ হয় পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে।
৩. এলিজাবেথ জিগলার
এলিজাবেথ জিগলারের নাম হয়ত আপনারা আগে কখনো শোনেননি। কিন্তু জগন্নাথ মন্দিরে রয়েছে তাঁর বিপুল অংকের আর্থিক অনুদান। ২০০৬ সালে সুইডেনের বাসিন্দা এলিজাবেথ জিগলার পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে তৎকালীন ১ কোটি ৭৮ লক্ষ টাকা দান করেছিলেন মন্দিরের উন্নয়নকল্পে। কোন একক ব্যাক্তির পক্ষে এটিই ছিল জগন্নাথ মন্দিরের ইতিহাসে প্রাপ্ত সর্বোচ্চ দান। কিন্তু শুনে আশ্চর্য হবেন, এই ব্যাক্তি জন্মসূত্রে খ্রীষ্টান ধর্মের অনুসারী হওয়ার কারনে তিনিও এই মন্দিরে প্রবেশাধির পাননি।
৪. বি আর আম্বেদকর
ডক্টর ভীমরাও রামজি আম্বেদকর। কি চমকে গেলেন? হ্যাঁ ইনিই সেই বিখ্যাত ব্যাক্তি যিনি ভারতবর্ষের সংবিধানের রচনা করেছিলেন। তিনি ছিলেন একাধারে একজন জ্যুরিস্ট, রাজনৈতিক নেতা, বৌদ্ধ আন্দোলনকারী, দার্শনিক, চিন্তাবিদ, নৃতত্ত্ববিদ, ঐতিহাসিক, সুবক্তা, লেখক, এবং অর্থনীতিবিদ। দলিত হিসেবে জন্মগ্রহণ করে তিনি সারাজীবন বর্ণপ্রথার বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন এবং জীবনের শেষভাগে বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। ১৯৪৫ সালে এই মহাপণ্ডিত ইংরেজদের শেষ ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেনকে নিয়ে পুরী গিয়েছিলেন মন্দিরে প্রবেশ করে জগন্নাথ দেবের দর্শন করার উদ্দেশ্যে। কিন্তু অহিন্দু হওয়ার কারনে তাঁদের দুইজনকেই মন্দিরের দ্বারপ্রান্ত থেকে ফিরিয়ে দেওয়া হয় খালি হাতে।
৫. লর্ড কার্জন
লর্ড কার্জনের নাম শুনেছেন নিশ্চই। ১৮৮৯ সাল থেকে ১৯০৫ সাল পর্যন্ত তিনিই ছিলেন ব্রিটিশ ভাইসরয় বা বড়লাট। জন্মসূত্রে তিনি বৃটিশ হলেও ভারতীয় সংস্কৃতি ও পুরাতত্ত্বের উপরে তাঁর ছিল বিশেষ ঝোঁক। সেই নেশা থেকেই তিনি ১৯০০ সালে পুরীতে গিয়েছিলেন জগন্নাথ মন্দিরে প্রবেশ করার জন্য। কিন্তু কি আশ্চর্য, সেই পরাধীন ভারতবর্ষের শাসকদের একজন দোর্দণ্ডপ্রতাপ প্রতিনিধিকেও প্রবেশাধিকার দেয়নি পুরীর মন্দির। মন্দিরের পান্ডারা তাঁকে জানিয়ে দিয়েছিলেন, জগন্নাথ মন্দিরে অহিন্দুদের প্রবেশের অনুমতি নেই।
৬. মহাচক্রী শ্রীনিধর্ন
মহাচক্রী শ্রীনিধর্ন ছিলেন থাইল্যান্ডের ক্রাউন প্রিন্সেস। ২০০৫ সালের নভেম্বরে এক রাষ্ট্রীয় সফরে ভারতে এসেছিলেন থাইল্যান্ডের এই রাজকুমারী। কিন্তু তাঁর বেলাতেই ঘটল সেই একই ঘটনা। মহাচক্রী বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী হওয়ার কারনে তাকেও ঢুকতে দেওয়া হয়নি পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে। ফলে মন্দিরে বাইরে থেকেই মন্দির পরিদর্শন করে ফিরে যেতে হয়েছিল তাঁকে।
৭. সন্ত কবীর
১৪ শতকের বিখ্যাত কবি ও সাধু ছিলেন কবীর। প্রাচীন ভারতের এই কবি সেই সময়ে দাঁড়িয়ে গেয়েছিলেন জাতিগত সম্প্রীতির গান। পেশায় তাতী হলেও তাঁর গান ও কবিতায় তিনি ক্তি আন্দোলনকে প্রভাবিত করেন। তাঁর মতবাদ ছড়িয়ে পড়ে শিখবাদ, মরমিয়াবাদ এবং সুফিবাদ নামেও। যখন তিনি পুরীতে পৌছান তখন তিনি ছিলেন তাগিয়া টুপি পরিহিত। এরপর তিনি পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে প্রবেশ করতে চাইলে তাঁর পরিহিত টুপির কারনে পাণ্ডারা তাকে মন্দিরে প্রবেশ করতে বাঁধা প্রদান করেন। কথিত আছে, পরবর্তীতে জগন্নাথদেব স্বয়ং পাণ্ডাদের স্বপ্নে এসে কবীরকে মন্দিরে প্রবেশাধিকার আদেশ দেন এবং তাকে সন্মান প্রদর্শন করতে নির্দেশ দেন। এরপর পাণ্ডারা কবিরকে পুনঃরায় কবীরকে খুঁজে বের করেন এবং তাঁকে জগন্নাথ দেবের দর্শন লাভ করান।
৮. ইন্দিরা গান্ধী
আজ্ঞে হ্যাঁ, ভারতের সাবেক শ্রীমতী প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর কথাই বলছি। ভারতের প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরুর কন্যা ও ভারতের প্রথম নারী প্রশানমন্ত্রীও ছিলেন শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী। পিতা জওহরলাল নেহেরু কাশ্মীরি ব্রাহ্মণ হওয়ার সুবাদে ইন্দিরাও ছিলেন জন্মগতভাবে হিন্দু ব্রাহ্মণ। ১৯৮৪ সালে প্রধানমন্ত্রীর দায়ীত্ব পালন করাকালীন সময়ে, তিনি গিয়েছিলেন পুরীর জগন্নাথ দেবের মন্দিরে প্রবেশ করে দেবতাদর্শন করার জন্য। কিন্তু গোল বাঁধল অন্য জায়গায়। ইন্দিরা গান্ধী নিজে ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান হওয়ার সত্ত্বেও বিবাহ করেছিলেন ফিরোজ গান্ধীকে। আমাদের সমাজে বিয়ের পরে যেহেতু মেয়েদের গোত্র, বর্ণ, ধর্ম বদলে যাওয়ার সংস্কার প্রচলিত রয়েছে, তাই ইন্দিরাও বিয়ের পরে হয়ে যান অ-হিন্দু। ফলে মন্দিরের পান্ডাদের বাঁধার মুখে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে ফিরে আসতে হয় জগন্নাথ মন্দিরের দ্বার থেকে।
৯. মহাত্মা গান্ধী
হ্যাঁ, জাতির জনক মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী বা মহাত্মা গান্ধীর কথাই বলছি। সময়টা ১৯৩৪ সাল। বিনোদা ভাবেকে সঙ্গে নিয়ে পুরী গিয়েছিলেন বাপুজি। তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল দলিত হিন্দু, খীষ্টান ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদেরকে সঙ্গে নিয়ে পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে প্রবেশ করা ও দেববিগ্রহ দর্শন করা। দল বেঁধে তাঁরা এগিয়েও চলেন মন্দির অভিমুখে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর উদ্দেশ্য সফল হয়নি তাঁর। এক পর্যায়ে তাঁদের মন্দিরে প্রবেশ রদ করেন মন্দির কর্তৃপক্ষ। যদিও হিন্দু হওয়ার সুবাদে শুধুমাত্র মহাত্মা গান্ধীকে মন্দিরে প্রবেশের সুযোগ দিয়েছিলেন পান্ডারা, কিন্তু গান্ধী তাঁদের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন এবং মন্দিরের মূল ফটক থেকে হরিজনদের নিয়ে বিরাট পদযাত্রা করেছিলেন। তবে তিনি প্রবেশ না করলেও তাঁর স্ত্রী কস্তুরবা কিন্তু দর্শনলাভ করেছিলেন পুরীর মন্দিরের জগন্নাথ দেবের।
১০. শ্রীল প্রভুপাদ
এ যাবতকালে যাদেরকে জগন্নাথ মন্দিরে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে আশ্চর্যজনক নামটি হচ্ছে এ.সি.ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ বা শ্রীল প্রভুপাদ। ইসকনের মত ভক্তি আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতাকে এ মন্দিরে প্রবেশ করতে না দেওয়াটা ইতিহাস হয়ে রয়ে গেছে জগন্নাথ মন্দিরের ইতিহাসে। তখন ১৯৭৭ সাল। পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের সকল পাণ্ডা ও বিদ্ধান ব্যক্তিদের উদ্দেশ্য প্রবচন প্রদানের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয় এ.সি.ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ। তাঁদের আমন্ত্রন স্বীকার করে সেই বছরেরই ২৬ জানুয়ারি এই মন্দিরে এসেছিলেন প্রভুপাদ। কিন্তু ভক্তি আন্দোলনের এই নেতার সাথে ছিলেন অগণিত বিদেশী ভক্ত ও পর্যটক। তাঁরা কৃষ্ণনামে প্রভাবিত ছিলেন বৈকি, তবে জন্মগতভাবে তাঁরা সবাই ছিলেন অহিন্দু। তাই তাঁদের প্রবেশাধিকার রধ করেছিলেন পাণ্ডারা। তবে গান্ধীর মত শুধুমাত্র তাঁকে মন্দিরে প্রবেশের প্রস্তাব দেওয়া হয় মন্দিরের পক্ষ থেকে। কিন্তু তিনিও পান্ডাদের প্রস্তাব অস্বীকার করেন এবং জগন্নাথ দেবের দর্শন না করেই পুরী ত্যাগ করেন।
পুরীর শ্রীশ্রী জগন্নাথ দেবের মন্দিরের প্রবেশাধিকার সম্পর্কে আপনার কি বক্তব্য তা আমাদেরকে কমেন্ট করে জানাতে ভুলবেন না।