পয়লা বৈশাখের ঠিক পরেই তথা চান্দ্র বৈশাখের শুক্লপক্ষের ৩য়া তিথিকে বলা হয় অক্ষয় তৃতীয়া। আপামর বাঙালীর কাছে এ এক মহাপুণ্যদায়ক উৎসব। বলা হয় এদিন সূর্য ও চাঁদ উভয়ের ঔজ্জ্বল্যই একেবারে তুঙ্গে থাকে। তাই যা কিছু শুভ, মঙ্গলজনক ও ভবিষ্যতের অবলম্বন তা এই দিনেই শুরু করে থাকেন সনাতন ধর্মাবলম্বী মানুষ। সামাজিক উৎসবের পাশাপাশি দোকানে দোকানে চলে পুজো, হালখাতা, নতুন লক্ষী-গণেশ, খরিদ্দারকে মিষ্টির প্যাকেট আর ক্যালেন্ডার প্রদান। কিন্তু এ তো গেল লোকাচারের কথা। আমরা কয়জনই বা জানি অক্ষয় তৃতীয়ার মাহাত্ম্য? কেন পালন করা হয় অক্ষয় তৃতীয়া? কি ঘটেছিল অক্ষয় তৃতীয়াতে? কেনইবা এমন নাম হল এই তিথিটির? তাছাড়া এই দিনে অনেকে সোনা রূপার গহনাও কিনে থাকেন। তবে কি অক্ষয় তৃতীয়াতে শুধুমাত্র গহনা কিনলেই ফিরবে ভাগ্য? প্রশ্ন অনেক, কিন্তু উত্তরগুলো আমাদের অনেকেরই অজানা। তো চলুন তাহলে বেরিয়ে পড়ি অজানাকে জানতে। আসুন জেনে নিই অক্ষয় তৃতীয়া আসলে কি? আর অক্ষয় তৃতীয়াতে নিশ্চিতরূপে নিজের ভাগ্য ফেরাতে কি কি করবেন এই দিনে।
মানুষের জীবনে অক্ষয় তৃতীয়ার মত সুবর্ণ তিথি আর নেই বললেই চলে। এই তিথিতে রোহিনী নক্ষত্র ও শোভন যোগ সবচেয়ে শুভ বলে মনে করা হয়। সনাতন বিশ্বাস মতে, অক্ষয় তৃতীয়ায় বিষ্ণুর পুজো করলে সম্পদ বৃদ্ধি হয়। একইসঙ্গে বিষ্ণু ও শিবের পুজো করলেও শুভ ফল পাওয়া যায়। গঙ্গায় স্নান করতে যাওয়া সম্ভব না হলে বাড়িতেই গঙ্গাজলে স্নান করার পর বিষ্ণুমূর্তিতে মাখাতে হবে চন্দন । এর সঙ্গে দিতে হবে তুলসিপাতা। সম্ভব হলে বেলফুলও দেওয়া যেতে পারে। এছাড়া দুধ, দই, ঘি, মধু ও চিনি দিয়ে পঞ্চামৃতও তৈরি করা যেতে পারে। অক্ষয় তৃতীয়ার পুজোর ফর্দের মধ্যে রয়েছেঃ সিদুঁর, পঞ্চগুঁড়ি, পঞ্চগর্ব্য, তিল, হরিতকী, ফুল, দুর্ব্বা, তুলসি, বিল্বপত্র, ধূপ, প্রদীপ, ধূনা, মধুপর্ক বাটি ২, আসনাঙ্গুরীয় ২, দই, মধু, চিনি, ঘি, পুজোর জন্য কাপড় , শাড়ি , নৈবেদ্য , কুচো নৈবেদ্য , সভোজ্য জলপূর্ণ ঘট , বস্ত্র , পাখা, এবং দক্ষিণা। তবে কাঙ্ক্ষিত ফল লাভের জন্য পরপর আট বছর ব্রতটি উদযাপন করতে হয়।
পুরাণ অনুযায়ী, মহাভারতে পাণ্ডবরা যখন নির্বাসনে ১৩ বছর কাটিয়ে ফেলেন, তারপর একদিন ঋষি দুর্বাসা তাঁদের আস্তানায় প্রবেশ করেন। দ্রৌপদী তাঁকে অক্ষয় পাত্রে খেতে দেন। এই আতিথেয়তায় মুগ্ধ হয়ে দুর্বাসা বলেন, ‘আজ অক্ষয় তৃতীয়া। আজ যে ছোলার ছাতু, গুড়, ফল, বস্ত্র, জল ও দক্ষিণা দিয়ে বিষ্ণুর পুজো করবে, সে সম্পদশালী হয়ে উঠবে।’
বৈদিক বিশ্বাসানুসারে এই পবিত্র তিথিতে কোন শুভকার্য সম্পন্ন হলে তা অনন্তকাল অক্ষয় হয়ে থাকে। যদি ভালো কাজ করা হয় তার জন্যে আমাদের লাভ হয় অক্ষয় পূণ্য আর যদি খারাপ কাজ করা হয় তবে লাভ হয় অক্ষয় পাপ। তাই এদিন খুব সাবধানে প্রতিটি কাজ করা উচিত। খেয়াল রাখতে হবে ভুলেও যেন কোনো খারাপ কাজ না হয়ে যায়। কখনো যেন কটু কথা না বেরোয় মুখ থেকে। কোনো কারণে যেন কারো ক্ষতি না করে ফেলি বা কারো মনে আঘাত দিয়ে না ফেলি। তাই এদিন যথাসম্ভব মৌন থাকা জরুরী। আর এদিন পূজা, জপ, ধ্যান, দান, অপরের মনে আনন্দ দেয়ার মত কাজ করা উচিত। যেহেতু এই তৃতীয়ার সব কাজ অক্ষয় থাকে তাই প্রতিটি পদক্ষেপ ফেলতে হয় সতর্কভাবে। এদিনটা ভালোভাবে কাটানোর অর্থ সাধনজগতের অনেকটা পথ একদিনে চলে ফেলা।
প্রশ্ন হচ্ছে, কি ঘটেছিল অক্ষয় তৃতীয়ার পুণ্যলগ্নে?
- কুবেরের ধন-ঐশ্বর্যের কথা কে না জানে। বলা হয় এদিনই কুবেরের তপস্যায় তুষ্ট হয়ে মহাদেব তাঁকে অতুল ঐশ্বর্য প্রদান করেন। কুবেরের লক্ষ্মী লাভ হয় বলে এদিন ভৈরব লক্ষ্মীর পুজো করা হয়।
- এই দিনই বন্ধু সুদামা ও দ্রৌপদীকে অক্ষয়পত্র দিয়ে ধনসম্পদে ভরিয়ে দিয়েছিলেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। আবার এই দিনেই জন্ম হয়েছিল মা অন্নপূর্ণার।
- পুরাণমতে, অক্ষয় তৃতীয়ার শুভ তিথিতেই জন্ম নিয়েছিলেন ভগবান বিষ্ণুর ষষ্ঠ অবতার পরশুরাম।
- এদিনই দুঃশাসন দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ করতে যান এবং সখী কৃষ্ণাকে রক্ষা করেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। শরনাগতের পরিত্রাতা রূপে এদিন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ দ্রৌপদীকে রক্ষা করেন।
- বলা হয় তীর্থংকর ঋষবনাথ এই দিনেই তার এক বছরের উপবাস ভংগ করেছিলেন।
- আবার এই দিনেই মহাভারতের রচনা আরম্ভ করেছিলেন মহর্ষি বেদব্যাস ও গণেশ। বলা হয়, মহর্ষি বেদব্যাস হিমালয়ের এক পবিত্র গুহায় তপস্যা করেছিলেন। তখনই মনে মনে রচনা করেন মহাভারত। তিনি চেয়েছিলেন এই মহাকাব্য সিদ্ধিদাতা গণেশই লিপিবদ্ধ করুন। সিদ্ধিদাতা গণেশ তাতে রাজি হন। কিন্তু শর্ত ছিল, গণেশ একবার লেখা শুরু করলে, তা শেষ না হওয়া পর্যন্ত বেদব্যাস তাঁর আবৃত্তি থামাতে পারবেন না। সেই শর্তের পালটা শর্ত রাখেন বেদব্যাস। তিনি বলেন, একটি শ্লোকের মর্মার্থ না বুঝে গণেশ সেটি লিখতে পারবেন না। গণেশ সেই শর্তে রাজি হয়ে যান। এই ভাবে সম্পূর্ণ মহাভারত রচনা করতে প্রায় ৩ দৈব বছর সময় লেগে গিয়েছিল।
- তাছাড়া, এই দিনেই সত্য যুগের সূচনা হয়েছিল। বলা হয়, রাজা ভগীরথ এদিনই গঙ্গা দেবীকে মর্তে নিয়ে আসেন পূর্বপুরুষদের মুক্তি দেবেন বলে।
- অক্ষয় তৃতীয়া পুরীর জগন্নাথ দেবের মন্দিরেরও একটি তাৎপর্যপূর্ণ দিন। অক্ষয় তৃতীয়ার শুভদিনেই পুরীধামে জগন্নাথদেবের রথযাত্রা উপলক্ষে রথ নির্মান শুরু হয়।
- এবং কেদারনাথ, বদ্রীনাথ, গঙ্গোত্রী ও যমুনোত্রী – এই চারধামের মন্দির ছ’মাস বন্ধ থাকার পর, অক্ষয় তৃতীয়াতে এগুলো আবার খুলে দেওয়া হয়। দ্বার খুললেই দেখে যায় সেই অক্ষয় প্রদীপ যা ছ’মাস আগে জ্বালিয়ে মন্দিরের দ্বার বন্ধ করা হয়েছিল।
আর তাই অশুভ শক্তির বিনাশ ও শুভ শক্তির উত্থান হিসেবে দেখা হয় এই দিনকে। এবার আসুন জেনে নেওয়া যাক কীভাবে পালন করতে হবে অক্ষয় তৃতীয়া? এই দিন বাড়িতে লক্ষ্মী ও গণেশের পুজো বাঞ্ছনীয় ৷ লাল সালু কাপড়ের ওপর লক্ষ্মী ও গণেশের মূর্তি রেখে পুজো করা, ঠাকুর ঘরে সারারাত ব্যাপী ঘিয়ের প্রদীপ জ্বালানো, ইত্যাদি ছাড়াও গৃহপ্রবেশও করা যেতে পারে অক্ষয় তৃতীয়ার পুণ্যক্ষণে। বাস্তুশাস্ত্র বলছে, পূজা অর্চনার সময় গণেশের দুটি একই ধরনের ছবি বাড়িতে রাখলে তা মঙ্গলদায়ক।
সমস্ত নিয়ম মেনে এই দিনে ব্রত পালন করলে সকল সমস্যা থেকে মুক্তি লাভ হয়। বাংলার বাঙালি হিন্দুঘরের পুরুষ এবং মহিলারা সর্বসুখের অধিকারী হতে এবং মৃত্যুর পর বৈকুণ্ঠবাসের সৌভাগ্যলাভ করতে এই ব্রত পালন করেন। অক্ষয় তৃতীয়া ব্রত পালনের প্রথম পর্যায়ে প্রয়োজনীয় উপকরণ অর্থাৎ নতুন কাপড়, কলসী, যব, ভুজ্জি, তালপাতার পাখা ও গামছা প্রদান করতে হয়। দ্বিতীয় পর্যায়ে প্রথমে যব দিয়ে লক্ষ্মী-নারায়ণ পূজা করতে হয়। তারপর ভুজ্জি, জলভরা কলসী, তালপাতার পাখা,গামছা বা নতুন কাপড় ব্রাহ্মণকে প্রদান করতে হয়।এছাড়াও এই তিথিতে, সিদ্ধিদাতা গণেশকে দিনে দুবার আরাধনা করা হয়।
জ্যোতিষ ও বাস্তু শাস্ত্রমতে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের জন্য রয়েছে বিশেষ করনীয়।
- বলা হয় এদিন সোনা বা রূপা ক্রয় করলে তা সৌভাগ্য বয়ে আনে গৃহীর জীবনে। তবে যদি সোনা-দানা কেনার ক্ষমতা আপনার না থাকে তাহলে কিছুটা ডাল কিনে বাড়ি ফিরুন। অক্ষয় তৃতীয়ায় ডাল কিনলে সৌভাগ্য ও সমৃদ্ধি আপনার সঙ্গী থাকবে।
- অক্ষয় তৃতীয়ায় সবুজ শাক-সবজি কেনা অত্যন্ত শুভ হিসেবে বিবেচিত। জ্যোতিষমতে এই পাতা ওয়ালা সবজি অর্থের প্রতিরূপ। তাই এদিন সবুজ শাক-সবজি কেনা শুভপ্রদা।
- এদিন আপনি শস্যদানাও কিনতে পারেন। চাল, বার্লির মতো শস্যদানা কেনা খুবই শুভ ফলদায়ক। জ্যোতিষশাস্ত্র অনুযায়ী, চাল সব অশুভ প্রভাব দূরে সরাতে পারে। তাই এদিন চাল ও অন্যান্য শস্যদানা কিনলে সৌভাগ্য ঘরে আসে।
- হিন্দুশাস্ত্র মতে ঘি অত্যন্ত শুভ। মানসিক ও শারীরিক ক্ষতিকর উপাদান দূরে রাখতে সাহায্য করে ঘি। অক্ষয় তৃতীয়ায় ঘি কিনুন এবং ঘিয়ের প্রদীপ জ্বালান। ফল পাবেন হাতেনাতে।
- এছাড়াও অক্ষয় তৃতীয়ায় নারকেল কিনে তা কোনও ব্রাহ্মণকে দান করলে সৌভাগ্য আপনার সঙ্গী হবে।