সরস্বতী দেবী কে?
সরস্বতী দেবীর আবির্ভাব
এক সময় শ্রীব্রহ্মা সৃষ্টিকার্যের জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন। শান্তভাবে ধ্যানস্থ আছেন। কী করবেন, কী করা উচিত চিন্তা করছেন। এমন সময় তাঁর শরীর থেকে এক সুন্দরী দেবীমূর্তি প্রকাশিত হয়। দেবী ব্রহ্মাজীকে বললেন, হে বিধাতা আমি আপনার থেকে প্রকাশিত হলাম। এখন দয়া করে আপনি আমার স্থান এবং কী কর্ম তা নির্দেশ করুন। ‘ব্রহ্মা বললেন “তোমার নাম সরস্বতী। তুমি অবস্থান করো সকলের জিহ্বাতে বিশেষভাবে সুশিক্ষিত ব্যক্তিদের জিহ্বাতে তুমি নৃত্য করো।পৃথিবীতে তুমি একটি নদীরূপে প্রকাশিত হও।”
পুরাণে সরস্বতী
দেবী সরস্বতীর উপদেশ
দেবী বললেন, হে বৎস, তোমার মনে অনেক প্রশ্ন আছে বলে জানি। তুমি যদি এখন কিছু জানতে চাও, তবে বলো। তার্ক্ষ্য ঋষি জানালেন হে ভদ্রে, দয়া করে বলুন ইহলোকে মানুষের কল্যাণ কীভাবে হবে? দেবী সরস্বতী বললেন, হে তপবোন, যে ব্যক্তির হৃদয় শুদ্ধ, শাস্ত্র নির্দেশ যে যত্ন সহকারে পালন করে, তারই যথার্থ কল্যাণ হয়। কী কর্ম করলে মানুষ এ জীবনের পর উর্ধ্বগতি বা নিম্নগতি লাভ করে? যদি কোনো ব্যক্তি অন্য সাত্ত্বিক ব্যক্তিকে ধন দান, আশ্রয় দান, চিকিৎসা দান, অন্ন দান, বস্ত্র প্রভৃতি দান করে তবে সুখময় স্বর্গীয় গ্রহলোকে উপনীত হবে। যে ব্যক্তি কাম ও ক্রোধ দ্বারা নিরন্তর মোহাচ্ছন্ন থাকে, সে ঘোরতর নরকলোকে নিপতিত হবে।
ঋষি তার্ক্ষ্য আবার স্বরসতী দেবীকে প্রশ্ন করলেন, হে পরমাত্মারূপা প্রজ্ঞা, আপনি কে? দেবী সরস্বতী বললেন, আমি পরাপর বিদ্যারূপা দেবী। অর্থাৎ পরা বিদ্যা হচ্ছে ভগবান ও ভক্তি সম্বন্ধীয় বিদ্যা এবং অপরা বিদ্যা হচ্ছে জড়জগতের কর্মকান্ডীয় বিদ্যা। এ উভয় বিদ্যাই আমি জিবকে প্রদান করি
সরস্বতী পূজার বর্তমান প্রেক্ষাপট
বর্তমান সময়ে দেখা যাচ্ছে, মানুষ ধর্মের নামে নিজের ইন্দ্রিয় তৃপ্তিতে ব্যস্ত। এমনকি মানুষ মনে করছে তারা ধর্ম করছে, কিন্তু দেব-দেবীদের সামনে যে আচরণ করছে, তা এমনকি সভ্য সমাজে অপাঙক্তেয়। যুবক-যু্বতী, মধ্য বয়স্করা বলিউডের গানের তালে তালে নিজেদের ইন্দ্রিয় তোষণের চেষ্টা করছে, আর ভাবছে সে মায়ের বা দেবীর আরাধনা করছে। যে ধরনের আচরণ সে এমনকি নিজের মায়ের সম্মুখে করতে পারে না, সেই অসদাচরণ জগজ্জননী মায়ের তথাকথিত পূজার ছলে করছে।
এমনকি শোনা যায়, মায়ের পূজার জন্য যে অর্থ সংগ্রহ করনে, তা তারা নিজেদের ইন্দ্রিয় তোষণের জন্য বিভিন্ন জাগতিক (তথা যৌন উদ্দীপক) গানের আসরের আয়োজন করছে। কখনো কখনো মদ্যপানের জন্যও ব্যবহৃত হচ্ছে। তাই যথার্থ মনোভাব ও ভাগগাম্ভীর্য নিয়ে পূজা সম্পাদন করা। সর্বতোভাবে সন্তুষ্ট করে না এমন সব গান বা কার্য থেকৈ সম্পূর্ণরূপে বিরত থাকা। পূর্বেই বর্ণনা করা হয়েছে, কোন কার্য মাতা সরস্বতীকে সন্তুষ্ট করতে পারে। আমরা পর্যায়ক্রমে বর্ণনা করব কোন মনোভাবে আমাদের মায়ের উদ্দেশ্যে প্রার্থনা করা উচিত, কোন বাহ্যিক বিষয় মায়ের প্রার্থনায় গুরুত্ব বহন করে না, কোন প্রতিমায় মা অবস্থান গ্রহণ করেন।
সরস্বতী পূজা কি লৌকিক প্রথা?
আমরা বেশির ভাগই ধর্ম করি, পূর্বপুরুষের ধারা অনুযায়ী অথবা সকল কর্মের ফল লাভের জন্য অথবা না বুঝে আনন্দ পাই বলে পূজার লৌকিক প্রয়াস করি। এধরনের প্রয়াসের ফলে মনের শান্তি অনুভব হয় বটে; কিন্তু তা কি আমাদের বিদ্যা লাভের প্রকৃত উদ্দেশ্যে সাধিত হয়? এ ধরণের লৌকিক প্রয়ােসই লৌকিকতা বা প্রথাগত ধর্মাচার বলে পরিগণিত হয়।
উইকিপিডিয়া-এর সংজ্ঞানুযায়ী, লৌকিকতা ও কর্তব্যবোধে আচরিত অনুভূতিবিহীন ধর্মাচরণকে Ritual বলা হয়। আমরা হয়তো বেশির ভাগই লৌকিকতার কারণেই পূজা করছি; কিন্তু কীভাবে ধর্মাচরণ করলে বা পূজা করলে লৌকিকতা মুক্ত হয়ে প্রকৃত অর্থেই বিদ্যা লাভের পথে এগিয়ে যেতে পারব, সেভাবে এগিয়ে যাওয়া উচিত। প্রার্থনা বলতে শাস্ত্রে বলা হয়েছে-“প্রার্থনা হলো এমন একটি কার্য যার দ্বারা একজন ব্যক্তি তার মন ও চিত্তকে ভগবানে/দেবতার কাছে নির্দিষ্ট করতে পারে। প্রার্থনার মাধ্যমে আমরা ভগবানের/দেবতার কাছে আমাদের অসহায়ত্ব ও ক্ষুদ্রত্ব স্বীকার করে তাঁর চরণে সমর্পিত হই। প্রার্থনা মগ্ন হওয়ার অর্থ, পরমেশ্বর ভগবান/আরাধ্য দেবতার কথা স্মরণ করা, তাঁকে দর্শন করা, তার সঙ্গে কথা বলা অথবা তাঁর বিষয়ে চিন্তা করা। শ্রীমদ্ভাগবতে প্রার্থনায় আমাদের যা করতে বলঅ হয়েছে তা হলো:
১. তাঁর মহিমা কীর্তন, ২. কৃতজ্ঞতা স্বীকার, ৩. হৃদয়ের আকুলতা, ৪. ক্ষমা প্রার্থনা
প্রার্থনা আমাদের হৃদয় থেকে উৎসারিত হওয়া উচিত। যদি প্রার্থনা হৃদয় থেকে না আসে, তবে সেটা শুধুমাত্র মুখের কসরত ছাড়া আর কিছু হবে না। প্রাথমিক অবস্থায় হৃদয় থেকে প্রার্থনা করা কঠিন হতে পারে, তাই ভগবান/দেবতার কাছে আমাদের বিনীত হওয়ার অক্ষমতার জন্য অনুতপ্ত হয়ে বিনীত প্রার্থনা করা উচিত।
আমরা কোন বিদ্যা চাইব?
ভক্তগণও সরস্বতী পূজা করেন। কিন্তু মায়াবদ্ধ ও মায়ামুক্ত জীবের মধ্যে পার্থক্য আছে বলে তাদের পূজায়ও পার্থক্য আছে। মায়াগ্রস্ত জীবের মায়িক বস্তুতে আসক্তি থাকে। যখন জীব মায়ার সেবায় প্রবৃত্ত হন, তখন তিনি কর্মী; আবার যখন মায়ার বিদ্যাবৃত্তির সেবায় রত হন, তখন তিনি জ্ঞানী। ঈশোপনিষদে (শ্লোক-৯) বলা হয়েছে- “যারা অবিদ্যা অনুশীলন করে, তারা অজ্ঞানের ঘোর অন্ধকারময় লোকে প্রবেশ করে, যারা তথাকথিত বিদ্যা অনুশীলনে রত, তারা আরও ঘোরতর অন্ধকারময় স্থানে গতি লাভ করে।”
অর্থাৎ, অবিদ্যা বা অজ্ঞানতা নিঃসন্দেহে বিপজ্জনক, তবে বিপথচালিত বা ভ্রান্ত বিদ্যা তার চেয়ে আরো ভয়ংকর। গণশিক্ষার ক্ষেত্রে বর্তমান সভ্যতা যথেষ্ট অগ্রগতি লাভ করেছে। কিন্তু জীবের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে পারমার্থিক বিদ্যা বা পর বিদ্যা। সেখান থেকে বিমুখ হয়ে জড়-জাগতিক উন্নতিতে অত্যধিক গুরুত্ব আরোপ করায়, মানুষ পূর্বাপেক্ষা আরও অধিক অসুখী হয়ে পড়ছে। বিদ্যাবৃত্তি জড় বিষয়ে আসক্তি বৃদ্ধি করে।
জড় জগতে বন্ধনে আবদ্ধ জীবগণ অবিদ্যায় অবস্থিত। অবিদ্যার আবরণে তাদের প্রকৃত স্বরূপ আচ্ছাদিত। যারা মায়ামুক্ত, তাঁরা বিদ্যা ও অবিদ্যা উভয়ের স্বরূপ সম্যক প্রকারে অবগত আছেন। তারা নিজেদের ভগবানের দাস জ্ঞান করে ভগবানের সেবায় প্রকৃত হন। মায়াবশীভূত জীবগণ সত্ত্ব, রজ ও তমো গুণে আবদ্ধ হয়ে দেবতাদের ভজনা করেন। বিভিন্ন গুণসম্পন্ন জীবগণ তাদের নিজ নিজ রুচি অনুসারে শান্ত, শৈব, সৌর, গাণপত্র বা বৈষ্ণব নামে অভিহিত হন।
তারা ভোগবাসনা চরিতার্থ করার জন্য ধন কামনায় লক্ষ্মী এবং বিদ্যালাভ করে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য লৌকিক প্রথা অনুসারে দেবী স্বরস্বতীর পূজা করেন। তারা যে বিষয় কামনায় পূজা করেন তা সবই নশ্বর। আমি ধনী হবো, পন্ডিত হবো, সমাজে প্রতিষ্ঠিত হবো, সমগ্র জগতে আমার যশ কীর্তিত হবে। এসমস্ত বাসনা সবই নশ্বর। চারবেদ, ষড় দর্শন অধ্যয়ন করেও যদি ভগবানের প্রতি অহৈতুকী ভক্তির উদয় না হয় তবে সবই বৃথা। শাস্ত্রে বর্ণনা করা হচ্ছে- আচারহীনং ন পুনন্তি বেদা….। যে বস্তু দেহত্যাগের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের ত্যাগ করে সেসমস্ত বিষয় নিয়ে নিত্য আত্মার কতটুকু স্বার্থসিদ্ধি হতে পারে।
তাই যারা উন্নত বিচারবোধসম্পন্ন, তারা কখনো নশ্বর বিষয়ে মুগ্ধ হয়ে দুর্লভ মনুষ্য জীবনের সুযোগটুকু হেলায় হারাতে ইচ্ছা করেন না। ঐকান্তিকী ভক্তগণ সরস্বতী দেবীকে চিৎ-শক্তিরূপে পূজা করেন। ভাগবত কীর্তনের প্রারম্ভে শ্রীল সূত গোস্বামী মঙ্গলাচরণের মধ্যে পরাবিদ্যাস্বরূপিণী সরস্বতীর প্রণাম করছেন যে, “দেবীং সরস্বতীং ব্যঅসং ততো জয়মুদীরয়েৎ”। আদিগুরু শ্রীব্রহ্মার হৃদয়ে সৃষ্টি বিষয়ক স্মৃতি প্রকাশের জন্য যে সরস্বতী দেবী ভগবানের প্রেরণায় প্রকটিত হন, তিনি শ্রীকৃষ্ণকেই উপাস্য মনে করেন।
(লেখক : শ্রীপাদ মিত্রগোপা কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারী)