কাকভোরে বাড়ির উঠোন নিকিয়ে চুকিয়ে তকতকে, রাঙামাটির গোলা দিয়ে মেড়ুলির সজ্জা। চারপাশে দুধসাদা বাহারি আলপনা। শঙ্খলতা খুন্তিলতা চালতেলতার চিত্তির, লক্ষ্মীর প্যাঁজ আর ফুলকারি নক্সা। শিশিরভেজা তুলসিতলা, ওখানেই পাতা হয়েছে ইতুর আটন। একটা মাটির সরা বা মালসায় একতাল মাটি, তাতে ধান কচু মান বা হলুদগাছ। পাঁচ কলাই ছড়ানো অংকুর, কোথাও বা খাড়া কঞ্চির উপরে ঝুলছে ধানের শিস। একখান পিদিম জ্বলছে, কিম্বা মোমবাতির নরম আলো ছড়িয়ে পড়েছে চারপাশে। ইতুর ঘটে সিঁদুর দিয়ে পুতুল আঁকা, ঘটের কানায় জড়ানো কলমি আর শুশুনির দল-দাম। বাড়ির গিন্নিরা সকালেই চান করে ছালের কাপড় পরে রেডি, ইতুর পুজো নিয়ে যাবে বামুনবাড়ি। পুজোর শেষে গোল হয়ে শুনতে বসবে ব্রতকথা, চাল কলা আর সিধে নিয়ে বামুনগিন্নী সুর করে বলবে ইতুব্রতকথা।
অষ্টচাল অষ্টদুর্বা কলসপত্র ধরে
ইতুকথা একমনে শুন প্রান ভরে
এ হল বাঙালী সমাজের ইতু পুজার আবহমান কালচিত্র। হয়ত আধুনিকতার করল গ্রাস আজ অনেক ক্ষেত্রেই গ্রাস করে ফেলছে গায়ের বউ ঝিদের এই পার্বন। তাই সময় এসেছে এটা নিয়ে নতুন করে কথা বলার, জানানোর। ইতু পুজো কি? কেন করা হয় ইতু পুজো আর তাছাড়া ইতুপুজোর ব্রতকথা তো থাকছেই। এসব নিয়েই সনাতন এক্সপ্রেসের আজকের আয়োজন। আশা করি ভিডিওটির শেষ পর্যন্ত সাথেই থাকবেন।
আমাদের রাজ্যের মেয়েরা অগ্রহায়ণ মাসের প্রতি রবিবার ইতু ঠাকুরের পুজো করে থাকেন। ইতু পুজোর নিয়ম প্রসঙ্গে বলা হয়েছে কার্ত্তিক মাসের সংক্রান্তি থেকে অগ্রহায়ণ মাসের সংক্রান্তি পর্যন্ত পুজোর নিয়ম। অগ্রহায়ণ মাসের প্রতি রবিবারে পুজো করে সংক্রান্তির দিন পুজো সম্পাদন করতে হয়। অর্থাৎ ইতুকে বিসর্জন দিতে হয়।এই কারণে অগ্রহায়ণ মাসে রবিবারে ইতুর পুজো হয়। প্রাচীন পারস্যদেশে একসময় মিথু পুজো হতো। মিথু>মিতু>ইতু। প্রাচীনকালে কুমারী মেয়ের পতিলাভ আর সাংসারিক কল্যাণ কামনায় সূর্যের পুজো মহিলামহলে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। মহাভারতে কুন্তীপুত্র কর্ণ ছিলেন সুর্যেরই সন্তান। ড. আশুতোষ ভট্টাচার্য মনে করেন সূর্যের অপর নাম আদিত্য। এই আদিত্য থেক ইতু শব্দটি এসেছে। এবং শাক্তধর্মের প্রভাবে ইতু ক্রমশ দেবীতে পরিণত হয়েছেন। সূর্যদেবতা থেকে ইতু শষ্যদেবী লক্ষ্মীতে রূপান্তরিত হয়েছেন। এইকারণে তিনি ইতুলক্ষ্মী নামে রাঢ়বাংলায় পূজিত।
ইতু আসলে কে? ইতুর এক নাম মিত্র। অগ্রহায়ণ মাসে সূর্য মিত্র নামেই পরিচিত। প্রধানতঃ রবিবার পুজো করা হয় বলে একে সূর্যের পুজো বলা হয়। অবশ্য ইতু পুজোকে সূর্য উপাসনা বলা হলেও এই পুজোর রীতিও উপাচার বিশ্লেষণ করে ইতুকে মাতৃকাদেবী রূপেই গণ্য করে অনেকে। আসলে ইতুর ঘটের গায়ে পুতুলি আঁকা , ভেতরে শস্যদানা ও তৃণগুচ্ছ রাখা আর প্রতীকী শষ্যক্ষেত্র মাতৃপ্রতীক বলেই মনে হয়।
কার্ত্তিক সংক্রান্তির আগে থেকেই ইতুর পাত্র ও ঘটের পসরা কেনার জন্য মেয়ে বৌ রা কুমোরের দোকানে ভীড় করেন। খড়ের বিঁড়ের উপরেই ইতুর সরাকে বসানো হয়। সরাতে দেওয়া হয় মাটি। মাটি পূর্ণ সরা বা গামলার মাঝে একটি ঘট স্থাপন করতে হয়। বাকী অংশে কলমী, সরসে, শুষনীর মূলসহ শাক, ধানের বীজ, মানকচুর মূল লাগানো হয়। আর ছোলা ,মটর, মুগ, তিল, যব সহ আট রকমের ‘শস্যও ছড়ানো’ হয়। ইতুর গাছগুলোকে বাঁচানোর জন্য সরা বা গামলার মধ্যবর্তীস্থানে রাখা ঘটটিতে জল দেওয়া হয়। প্রতি রবিবার পুজোর সময় এই জল দিয়ে থাকে মেয়েরা।
কুমারী, সধবা, বিধবা সব মেয়েরা নিজেই এই পুজো করে থাকেন। প্রার্থনা জানান, যে জ্যোতির দ্বারা তুমি অন্ধকার নষ্ট কর এবং যে কিরণের দ্বারা সমস্ত বিশ্ব জগৎ প্রকাশ কর, তার দ্বারা আমাদের সর্বপ্রকার দরিদ্রতা নষ্ট কর, আমাদের পাপ, রোগ ও দুঃস্বপ্ন দূর কর। ইতুকে সাধভক্ষণের প্রথাও রয়েছে কোথাও কোথাও। সেদিন নতুন গুড় ও চাল দুধ দিয়ে পরমান্ন তৈরি করে নিবেদন করা হয়।
ইতুপুজো প্রসঙ্গে ড. আশুতোষ ভট্টাচার্য তাঁর বাংলার লোকনৃত্য গ্রন্থে বলেছেন, সূর্যব্রত ভারতের সকল নারী সমাজের একটি প্রধান ব্রত। সূর্য উর্বরা শক্তির আধার, সূর্যের আশীর্বাদে নারী সন্তান লাভ করে থাকে এবং সূর্যের অভিশাপেই নারী বন্ধ্যাত্বপাপ্ত হয়। সুতরাং সূর্যকে প্রসন্ন করতে না পারলে নারী কদাচ সন্তানের জননী হতে পারে না। সেজন্যই সূর্যকে প্রসন্ন করার এই প্রচেষ্টা।
আচার্য সুকুমার সেন একেবারে বিপরীত দৃষ্টিকোণ থেকে বলেছেন – ইতু হলেন প্রাচীন ইন্দ্রপুজোর দৃষ্টান্ত। তাঁর মতে ঋকবেদীয় সূক্তগুলির নাম ছিল ইন্দ্রস্তূত। তার থেকে কালক্রমে ইন্দথথু এবং ইন্দথথু থেকেই আজকের ইতু। ইন্দ্র বৈদিকযুগের প্রধান দেবতা। আবার বিয়ের দেবতাও ছিলেন তিনি। মেয়েদের ব্রত আচার কৃত্যে ইন্দ্র ক্রমশ স্থান লাভ করেন। ইন্দ্রের মত বরের কামনায় আজও ইন্দ্রদাদ্বশীর দিন মেয়েরা ইন্দ্রপুজো করে। অগ্রহায়ণ মাসে নতুন বছর শুরু হতো। এই সময়ে রবিশস্য বিশেষ করে গম যব সরিষা ইত্যাদি ফসল লাগানো হতো। কৃষির সঙ্গে প্রজনন সমার্থক। সুতরাং বোঝাই যায় ইতু আসলে সেই রবিশস্যের অঙ্কুরোদ্গমের কৃষি উৎসব।
কার্তিকসংক্রান্তির দিন ইতু-উৎসবের সূচনা। সমাপ্ত হয় অগ্রহায়ণ সংক্রান্তিতে। প্রতি রবিবারে মেয়েরা ইতুর ঘট এনে পুজো করে। ইতু পুজোয় লাগে চাল-কলাইয়ের নৈবেদ্য। আর ভোগে লাগে ভাজাপোড়া অর্থাৎ চাল-কলাই ভাজা। সংক্রান্তির দিনে ইতুলক্ষ্মীর বিশেষ ভোগে থাকে সরুচাকলির পদ। সেদিন পুজোর ফুল বলতে হলুদ সরিষার ফুল। পুজোর পর ইতুকে নদীতে বা পুকুরে বিসর্জন দেওয়ার রীতি।
এবার আসুন জেনে নেওয়া যাক এই ব্রতের পেছনে প্রচলিত কাহিনী।
এক দেশে এক গরিব বামুন তার স্ত্রী ও দুই মেয়েকে নিয়ে বাস করত। বামুন ভিক্ষে করে যা পেত তা দিয়েই তার সংসার চলত।বামুনের একদিন পিঠে খাবার ইচ্ছে হয়। সে অতি কষ্টে ভিক্ষে করে চাল, নারকেল, গুড়, তেল সব যোগাড় করে বামুনিকে পিঠে তৈরি করতে বলে আর বলে যেন কাউকে একটাও পিঠে না দেয়। এর পর বামুন রান্না ঘরের পিছনে লুকিয়ে বসে থাকে, আর বামুনি কড়াতে একটা করে পিঠে ভাজলে তার ছ্যাক ছ্যাক শব্দে বামুন দড়িতে একটা করে গিঁট দিয়ে কতগুলো পিঠে হলো তা গুনে রাখে।এর পর বামুনী বামুন কে পিঠে খেতে দিলে বামুন দড়ির গিঁট খুলতে খুলতে দেখে দুটো পিঠে কম। বামুনের রাগ দেখে বামুনি ভয়ে তার দুই মেয়েকে দুটো পিঠে দেবার কথা বলে। এই শুনে বামুন তার দুই মেয়েকে তাদের মাসির বাড়ি রেখে আসবে বলে। মেয়ে দুটির নাম উমনো আর ঝুমনো।
পরের দিন ভোর বেলা উমনো আর ঝুমনোকে সঙ্গে করে বামুন বাড়ি থেকে বের হয়। দিনটা ছিল কার্তিক মাসের সংক্রান্তির আগের দিন। সারা দিন চলতে চলতে তারা এক জঙ্গলে এসে উপস্থিত হয়। সেখানে বামুন তাদের ঘুম পাড়িয়ে ফেলে রেখে চলে যায়। গভীর রাতে বাঘ,ভালুক এর শব্দে উমনো আর ঝুমনোর ঘুম ভেঙে যায়। ভয়ে তারা খুব কাঁদতে থাকে। কাতর স্বরে ভগবানকে ডাকতে থাকে। শেষে এক বট গাছের কাছে গিয়ে হাত জোর করে দুজনে বলে “হে বট বৃক্ষ! মা আমাদের দশ মাস দশ দিন গর্ভে স্থান দিয়েছেন। তুমি আজ রাতের জন্য তোমার কোটরে স্থান দাও।”
এর পর বট গাছ দু ফাঁক হয়ে গেলে তারা দু বোনে বট গাছের কোটরে রাত কাটায়,সকাল হতে তারা বট গাছকে প্রণাম করে জঙ্গলের পথ ধরে চলতে শুরু করে। চলতে চলতে তারা দেখে সামনে একটা বাড়ি। সেখানে মাটির সরা করে মেয়েরা পুজো করছে। বাড়ির কাছে পৌঁছলে দুটো ফুটফুটে মেয়ে দেখে বাড়ির গিন্নি তাদের সব কথা জিজ্ঞেস করলে তারা কাঁদতে কাঁদতে সব কথা খুলে বলে। বাড়ির মেয়েরা ঘটে করে কি পূজা করছে জিজ্ঞেস করলে গিন্নি জানায় এর নাম ইতু পুজো। আগের দিন উপোষ করে থাকলে তবেই ইতু পুজো করা যায়। এই কথা শুনে উমনো ঝুমনো বলে কাল থেকে তারা তো কিছুই খায়নি। তখন গিন্নি তাদের পুজোর জোগাড় করে দিলে তারাও কার্তিক মাসের সংক্রান্তিতে ইতু পুজো করে। তাদের নিষ্পাপ ভক্তি দেখে ইতু ভগবান অর্থাৎ সূর্যদেব তাদের বর প্রার্থনা করতে বলে। তারা তাদের বাবার দুঃখ দূর হবার প্রার্থনা জানায়। সূর্যদেব তাদের মনকামনা পূরণ হবার আশীর্বাদ করেন। তারপর তারা অগ্রহায়ণ মাসের প্রতি রবিবারে ভক্তি সহকারে ইতু পুজো করে সূর্য দেবের কাছ থেকে আশীর্বাদ পেতে থাকে।
ওই দিকে বামুনের ঘর ধনে ভরে উঠলেও বামুনির মুখে হাসি নেই। সে খালি মেয়েদের কথা ভাবে আর চোখের জল ফেলে। এই ভাবেই দিন যায়। এক দিন উমনো আর ঝুমনো বাড়ি ফিরে আসে। তা দেখে বামুন বামুনির আনন্দের শেষ থাকেনা। বামুনের অবস্থা তখন ভালই তাই তার মেয়েদের যত্নের শেষ নেই। কিন্তু তারা ইতু পুজোর কথা ভোলে নি,বাড়ি ফিরে তারা আবার পুজো আরম্ভ করে দেয়। তা দেখে বামুন তাদের কি পুজো করছে তা জানতে চায়।তারা ইতু পুজোর কথা বলে,আর সূর্য দেবের আশীর্বাদেই যে তাদের বাবার অবস্থা ভালো হয়েছে সেটাও বলে। তা শুনে বামুনিও ইতু পূজা শুরু করে দেয়। তাদের অবস্থা ক্রমশ ভালো হতে থাকে। এই ভাবে দিকে দিকে এই ইতু পূজার মাহাত্য ছড়িয়ে পড়ে।
ব্রতগল্পটি থেকে প্রাচীন ইতিহাসের অনেক বিলুপ্তপ্রায় প্রথার সন্ধান মেলে। যেমন দড়িতে গিঁট মেরে মনে রাখার প্রথা প্রাচীন গ্রন্থিলিপিকে স্মরণ করায়। পেরু পলেনেশিয়া এমনকি প্রাচীন চীনেও এই লিপির প্রচলন ছিল। এর নাম কুইপান বা কুইপু লিপি। বিশেষজ্ঞদের মতে, ব্রতগল্পটিতে ইন্দো-ইউরোপীয় লোকগল্পের মোটিফগুলিও সুস্পষ্ট রূপে ধরা পড়েছে। যেমন – মেয়েদের বনবাসে পাঠানো, দুর্ভাগ্য জয় করে বাড়িতে পুনপ্রায় ফিরে আসা, বৃক্ষের অভ্যন্তরে আশ্রয় লাভ ইত্যাদি।