You are currently viewing জন্মাষ্টমী কি? কেন ও কিভাবে পালন করবেন শ্রীকৃষ্ণজয়ন্তী?

জন্মাষ্টমী কি? কেন ও কিভাবে পালন করবেন শ্রীকৃষ্ণজয়ন্তী?

একজন সনাতন ধর্মাবলম্বী হিসেবে আপনি আমি প্রতিবছরই পালন করি জন্মাষ্টমী। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জন্মতিথিকে বলা হয় জন্মাষ্টমী।  3. দ্বাপরযুগে অত্যাচারী রাজা, অসুর প্রভৃতির সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে এবং কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের চরম পরিনতি দান করার উদ্দেশ্যে ধরাধামে অবতীর্ণ হন ভগবান বিষ্ণুর পুর্ণাবতার ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। দেবকীর গর্ভে জন্ম নিয়ে তিনি পালিত হয়েছিলেন নিজ পিতা বসুদেবের ভ্রাতা নন্দের আলয়ে। পালিকা মাতা হিসেবে পেয়েছিলেন মা যশোদাকে। অসংখ্য অত্যাচারী রাজা ও অসুর বধ করে এবং কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের পরিনতি দান করে তিনি পুনরায় শান্তি স্থাপন করেছিলেন সমগ্র আর্যাবর্তে। ১২৫ বছরের লীলাজীবনে তিনি আমাদেরকে দান করেছেন শ্রীমদ ভগবদ গীতার মত বিরল জ্ঞান, মার্গদর্শন করেছিলেন, ধর্মভীরু পঞ্চপান্ডবদের এবং পৃথিবীকে পরিত্রাণ দান করেছিলেন বহু অত্যাচারীর হাত থেকে। জন্মাষ্টমীর এই মহালগ্নে আজ আমরা আলোচনা করতে চাই পুর্ণাবতার ভগবান শ্রীকৃষ্ণের পার্থিব জীবনের কিছু চম্বুক অংশ নিয়ে। বস্তুত এ আলোচোনা থেকে আমরা জানার চেষ্টা করব-

  • ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জন্মোৎসবকে জন্মদিন না বলে জন্মাস্টমী বলা হয় কেন?
  • কেন শ্রীকৃষ্ণের ৬ সহোদরকে বধ করেছিলেন কংস?
  • জন্মাস্টমী ব্রত সঠিকভাবে পালন করার নিয়ম কি?
  • জন্মাস্টমীতে উপবাসের সঠিক নিয়ম এবং উপবাস মাহাত্ম্য
  • এছাড়াও জানব এদিন কি কি উপাচারে শ্রীকৃষ্ণের ভোগ নিবেদন করতে হবে সে বিষয়ে।
আরও পড়ুনঃ  মহাভারতের এই ব্যক্তিদের জন্ম স্বভাবিক ছিল না || How The Main Characters of Mahabharata Were Born?

জন্মাষ্টমীর ইতিহাস

প্রাচীন মথুরা শহরটি বিষাক্ত হয়ে উঠেছিল রাজা কংসের ভয়ানয়ক অত্যাচার ও নির্যাতনের কারনে। কংসের অত্যাচার শুরু হয়েছিল তার নিজের পিতা উগ্রসেনকে বন্দী করে নিজেকে রাজার স্থলাভিষিক্ত করার মধ্য দিয়ে যা পরবর্তিতে রূপ নেয় চরমতম অধর্ম ও প্রজা নিপীড়নে। রাজ্যজুড়ে চলছিল হাহাকার আর আর্তচিৎকার। মথুরাবাসী মনে প্রাণে আহবান করছিলেন তাদের ত্রাতাকে। এমনি এক সময় কংস তার ভগিনী দেবকীর বিবাহ সম্পাদন করেন বসুদেবের সাথে । নিজে রথের সারথী হয়ে কংস তার সদ্যবিবাহিত ভগিনী ও ভগ্নিপতিকে নিয়ে যাত্রা করছিলেন বোনের শ্বশুরালয়ে। ঠিক এমনই সময় গগন বিদীর্ণ করে দৈববাণী শোনা গেল “ হে কংস যে ভগিনীর রথের সারথী তুমি, সেই দেবকীর গর্ভের অষ্টম সন্তানই হবে তোমার সংহারকর্তা”

দৈববাণী শ্রবণ করে বিদ্যুতস্পৃষ্টের মত চকিত হয়ে উঠলেন কংস, ধারন করলেন তার রুদ্রমুর্তি। এরপর তীব্র ক্রোধে হত্যা করতে উদ্যত হলেন তার সদ্যবিবাহিতা বোন দেবকীকে। কিন্তু বসুদেবের অনুনয় শুনে দেবকীকে প্রাণে মারলেন না তিনি, শর্ত দিলেন, দেবকীর গর্ভের প্রত্যেক সন্তান ভুমিষ্ঠ হওয়ার পরেই তুলে দিতে হবে কংসের হাতে। একইসাথে ভগিনী ও ভগ্নিপতিকে কারাগারে নিক্ষেপও করলেন তিনি। এরপর একে একে মাতা দেবকীর গর্ভের ৬ ৬টি সন্তান একে একে জন্ম নেয় এবং এদের প্রত্যেককে আছাড় মেরে হত্যা করেন কংস। সপ্তম সন্তানকে দেবকীর গর্ভ হতে দৈব ঈঙ্গিতে স্থানাতরিত করা হয় শ্রীকৃষ্ণের বিমাতা রোহিনীর গর্ভে। সেখানে জন্ম হয় শ্রীবিষ্ণুর আরেক অবতার বলরামের। এরপর আসে সেই মহেন্দ্রক্ষন, মাতা দেবকীর অষ্টম গর্ভের সন্তানের ভুমিষ্ঠ হওয়ার দিন।  সেদিন ভাদ্র মাসের কৃষ্ণ পক্ষের অস্টমী তিথি আর তার সাথে রোহিনী নক্ষত্রের প্রভাব। প্রচন্ড ঝড় জলের রাতে চারিদিকে চোখ রাঙাচ্ছে ভয়ংকর বিভীষিকা। কারাগারের রক্ষীরাও ছিল দেবী যোগমায়ার প্রভাবে অচেতন। এমন সময় জগত আলো করে জন্ম নিলেন জগতের ত্রাতা, মনমোহন শ্রীকৃষ্ণ। এসময় শোকে বিহ্বল বসুদেব দৈববানী শুনতে পেলেন “ হে বসুদেব আপনি আপনার পুত্রকে যমুনা পার করে নন্দালয়ে যশোদার কাছে রেখে আসুন এবং যশোদার সদ্যোজাত কন্যাকে কারাগারে নিয়ে আসুন”

যখন কৃষ্ণ জন্ম নিল দৈবকী উদরে

মথুরায় দেবগন পুষ্পবৃষ্টি করে

বসুদেব রাখি আইল নন্দের মন্দিরে

নন্দের আলয়ে কৃষ্ণ দিনে দিনে বাড়ে।

আরও পড়ুনঃ  জীবিত শিবলিঙ্গ ! রহস্যজনকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে প্রতিবছর || Matangashwar Living Shivlinga

এদিকে দেবকীর অষ্টম গর্ভের সন্তানের ভুমিষ্ঠ হওয়ার সংবাদ পেয়ে কংস ছূটে এলেন কারাগারে। তারপর যখনই সেই কন্যা সন্তানকে আছাড় মারার উদ্দেশ্যে শুন্যে উত্তোলন করলেন, তখনই সেই কন্যা শুন্যপানে ভাসতে ভাসতে বললেন “ কংস, তোমারে বধিবে যে, গোকুলে বাড়িছে সে” এই কন্যাসন্তান ছিলেন স্বয়ং দেবী যোগমায়া।   বিশ্বসংসারের ত্রাতার মানবরূপে জন্মগ্রহনের এই তিথি পালিত হয় কৃষ্ণাষ্টমী, গোকুলাষ্টমী, অষ্টমী রোহিণী, শ্রীকৃষ্ণজয়ন্তীসহ নানান নামে। যেহেতু জন্মাষ্টমী নির্দারন করা হয় তিথি ও নক্ষত্র বিচারে তাই এইদিনটিকে শ্রীকৃষ্ণের জন্মদিন না বলে জন্মাষ্টমী বলা হয়। গবেষকদের মতে ৫২৪৬ বছর পুর্বে বা 3228 খ্রীষ্টপূর্বাব্দের ১৯ শে জুলাই  আবির্ভুত হন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ।

সমস্ত বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের ত্রাতা, ভগবান শ্রীকৃষ্ণের এই জন্মতিথি স্বাড়ম্বরে পালিত হয় সারা বিশ্বব্যাপী। তবে জন্মাষ্টমীর মূল পর্ব হচ্ছে এদিনকার উপবাস ব্রত। পরমেশ্বর ভগবানের মানবরূপে দেহধারন করার প্রতি সন্মান জানিয়ে এবং হিন্দু পুরাণ ও প্রাচীন শাস্ত্রের নির্দেশনা অনুযায়ী ভক্তগন এদিন উপবাস ব্রত পালন করে থাকেন। অর্থাৎ, জন্মাষ্টমীতে অন্নগ্রহন নিষিদ্ধ।

জন্মাষ্টমী তিথি এবং উপবাসের সময় নির্ণয়

জন্মাষ্টমী ব্রতদিন নির্ণয় করতে গিয়ে শাস্ত্রে বলা হয়েছে,

ভাদ্রমাসে কৃষ্ণাষ্টমী উপবাস যোগ্যা। রোহিণী নক্ষত্রযুক্তা হলে আরও অধিক ফলপ্রদা। আর নবমী তিথি সংযুক্তা হলে আরও অধিক ফলপ্রদা হয়। অর্থাৎ নবমী তিথি যুক্ত জন্মাষ্টমী অধিক শ্রেষ্ঠ।অন্যদিকে পূর্বতিথি সপ্তমী বিদ্ধা জন্মাষ্টমী সর্বদা ত্যজ্য।

পদ্মপুরাণে বলা হয়েছে,

যদিও পঞ্চগব্য পবিত্র, কিন্তু এতে মদ মিশলে আর তা গ্রহণযোগ্য থাকেনা, তেমনিভাবে রোহিণী নক্ষত্র সংযুক্তা হলেও সপ্তমীবিদ্ধা অষ্টমী গ্রহণযোগ্য নয়।

তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, সপ্তমী তিথি থাকার দরুন ঐ দিন অষ্টমী হলেও তা জন্মাষ্টমী নয়।

জন্মাষ্টমী ব্রত সঠিকভাবে পালন করার নিয়ম

১) জন্মাস্টমীর আগের দিন রাত ১২ টার আগে শুধু এক পদ দিয়ে রাতের খাবার খেয়ে ভক্তেরা জন্মাষ্টমীর দিন উপবাস রাখেন ও সংকল্প করেন। তবে ঘুমানোর আগে ব্রাশ করে নিতে পারেন।

২) জন্মাষ্টমীর দিন সকাল থেকে মধ্যরাত্রি পর্যন্ত উপবাস এবং জাগরণ। উপবাসের সময় কোনও দানা খাওয়ার নিয়ম নেই। উপবাস থেকে হরিনাম জপ, কৃষ্ণ লীলা শ্রবন, ভগবানকে দর্শন, ভক্ত সঙ্গে হরিনাম কীর্তন,, অভিষেক দর্শন করতে হবে এবং ভগবানকে অভিষেক করে একাদশীর দিনের মতো অনুকল্প প্রসাদ সেবন করতে হবে।

৩) যাদের উপবাস পালনে সমস্যা, অসুস্থ, তারা অবশ্যই দুপুর ১২ টার পরে, শ্রীকৃষ্ণের কাছে মার্জনা প্রার্থনা করে, সামান্য দুধ, বা ফল খেতে পারবেন। তবে বৈষ্ণব মতে জন্মাষ্টমী ব্রতে সম্পুর্ণ নির্জলা উপবাস করা হয়ে থাকে।

৪) পরের দিন সকালে স্নান করা শেষে এবং পারনের জন্য নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কৃষ্ণ প্রসাদ দিয়ে পারন করার পর সমাপ্ত হবে আপনার উপবাস পর্ব। এই দিন গোপালকে ৫৬ পদে ভোগ দেওয়ার নিয়ম। কৃষ্ণের প্রিয় মাখন, মিছরির সঙ্গে ফল, নানা রকম মেওয়া, নিমকি ইত্যাদি হল এই ৫৬ প্রকার পদের অন্যতম। এছাড়া পাকা তাল শ্রীকৃষ্ণের অধিক প্রিয় ফল। জন্মাষ্টমীতে তাই তালের বড়া, তাল ক্ষীর, তালের লুচির মতো নানাবিধ সুস্বাদু খাবারে সাজিয়ে দেওয়া হয় থালা। এ ছাড়াও মঠরি, রাবড়ি, মোহনভোগ, ক্ষীর, জিলিপি মতো নানা রকম মিষ্টি, শাক, দই, খিচুড়ি, দুধ, কাজু, মোরব্বা সব কিছু দিয়ে তৈরি হয় ছাপ্পান্ন ভোগ।

আরও পড়ুনঃ  যে ৫ কারনে মানুষের আয়ু কমে যায় - গরুড় পুরাণ || 5 Deeds That Reduces Life - Garuda Purana ||

এছাড়াও সারা পৃথিবী ব্যাপী জন্মাষ্টমী তিথি পালিত হয় নানা রঙে, বৈচিত্রে ও নিয়মে। দক্ষিণ ভারতে এদিন পালন করা হয় গোকুলাষ্টামি অন্যদিকে মহারাষ্ট্রে পালন করা হয় দইয়ের হাড়ি ফাটিয়ে। এ উতসবের নাম দহি হান্ডি। এদিন বৃন্দাবন ও মথুরায় প্রায় ৫০০ মন্দিরে বিষেষভাবে পুজা করা হয় শ্রীকৃষ্ণ, বলরাম ও শ্রীকৃষ্ণের ভগিনি তথা বিমাতা রোহিনীর কন্যা সুভদ্রাদেবীকে।

জন্মাষ্টমী ব্রত পালনের ফল

  1. সুস্থ পুত্রসন্তানের জন্ম হয়।
  2. সর্ব শত্রু বিনাশ হয়।
  3. সকল বাধা বিঘ্ন দূরীভূত হয়।
  4. ঐশ্বর্য প্রাপ্তি হয়।
  5. ঈশ্বর তাঁকে সর্বদা রক্ষা করেন।

আমাদেরকে ফলো করুনঃ ফেসবুক, টুইটার (এক্স), ইন্সটাগ্রাম, পিন্টারেস্ট, ইউটিউব

5/5 - (1 vote)

Leave a Reply