You are currently viewing কর্ণ এবং অর্জুনের শত্রুতা কোন জন্মের? তাদের মধ্যে কে শ্রেষ্ঠ? Karna Vs Arjun

কর্ণ এবং অর্জুনের শত্রুতা কোন জন্মের? তাদের মধ্যে কে শ্রেষ্ঠ? Karna Vs Arjun

কর্ণ এবং অর্জুন, মহাভারতের দুই শ্রেষ্ঠ ধনুর্ধর, সহোদর ভ্রাতা, দুই দেবপুত্র এবং চিরপ্রতিদন্দ্বী দুই যোদ্ধা। এই দুইজনের দোষ, গুন, শৌর্য-বীর্য নিয়ে আজ অবধি বহু আলোচনা সমালোচনা হওয়ার পরেও দুজনের মধ্যে আসলে কে শ্রেষ্ঠ তা নিয়ে সিদ্ধান্তে আসা যায় নি। কারন আমরা যেভাবে তাদেরকে নিয়ে আলোচনা সমালোচনা করে থাকি, বিষয়টা অতটা সহজ নয়। কর্ণ ও অর্জুনের শ্রেষ্ঠত্ব, বীরত্ব, কাপুরুষতা ও শত্রুতার উৎস বিচার করতে হলে আমাদেরকে যেতে হবে মহাভারতের বাইরে। দ্বারস্থ হতে হবে পুরাণের, যেতে হবে তাদের পুর্বজন্মের ঘটনাগুলোতে। আর এ যাত্রায় আপনার সাক্ষাৎ হবে প্রজাপতি ব্রহ্মা, জগতের প্রতিপালক বিষ্ণু, দেবাদিদেব মহাদেব, রাক্ষস শ্বেতজ, রক্তজ, দাম্বোদভব, এবং নর নারায়নসহ মহাভারতের কর্ণ ও অর্জুনের সাথে। শুধুমাত্র এগুলো জানার পরেই আপনি কর্ণ ও অর্জুনের প্রকৃত স্বরূপ জানতে পারবেন এবং তাদের মধ্যকার তুলনামূলক বিশ্লেষন করতে পারবেন। তবে কথা দিচ্ছি সম্পূর্ণ লেখাটি পড়লে আপনি এমন কিছু মহামুল্যবান তথ্য জানতে পারবেন যা টিভি সিরিয়াল নির্ভর কিছু ধারনা থেকে আপনাকে বের করে আনতে সামর্থ্য হবে।  তবে একটা কথা না বললেই নয়, আর তা হল এই লেখাটি কাউকে হেয় করার জন্য বা কাউকে অহেতুক বীর প্রতীয়মান করার জন্য লেখা হয়নি। বরং পুরাণমতে পুর্বজন্মের ঘটনা ও মহাভারতের কিছু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র তথ্যকনিকা সন্নিবেশিত করা হয়েছে তুলনামূলক বিচারের স্বার্থে।

পদ্মপুরাণ বলছে, একদা ব্রহ্মা ও বিষ্ণুর মধ্যে ব্রহ্মাণ্ডের ভারসাম্য বজায় রাখতে কার ভূমিকা বেশী গুরুত্বপূর্ণ তা নিয়ে আলোচনা চলছিল। কিন্তু এই কথোপকথন এক পর্যায়ে আলোচনা থেকে পরিনত হয় তর্কে। শেষমেশ এই তর্ক যখন ঝগড়ায় রূপ নেয় তখন মধ্যস্থতা করতে আসেন দেবাদিদেব মহাদেব। শিব ব্রহ্মাকে জিজ্ঞেস করেন, ‘আপনাদের এই তর্কের কারণ কী?’ ব্রহ্মা বলেন, ‘আমি যা বলছি তা-ই সত্য। আমিই এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে সকলকে সৃষ্টি করেছি। তাই আমার কাজই সব থেকে মহান। আমি না থাকলে কেউ থাকত না। এমনকী বিষ্ণুও নয়, মহাদেবও নয়।’ ব্রহ্মার কথায় শিব প্রচণ্ড ক্রুদ্ধ হন। শুরু হয় ব্রহ্মা ও শিবের মধ্যে বাদানুবাদ।  এক পর্যায়ে ব্রহ্মা নিজের মাথার ঘাম নীচে ফেলে বলেন, ‘আমার এই ক্রোধের ঘাম থেকে এক অসুরের জন্ম হোক।’ এরপর ব্রহ্মার সেই ঘাম থেকে এক ভয়ানক অসুর উৎপন্ন হয় যার নাম দেওয়া হয় ‘শ্বেতজ’। তার শরীরে এক হাজার কবচ। এ জন্য তাকে সহস্রকবচও বলা হয়। ব্রহ্মা শ্বেতজকে আদেশ দেন, ‘তুমি এখনই মহাদেবকে হত্যা করে আমার অপমানের বদলা নাও।’

ব্রহ্মার ঘাম থেকে উৎপন্ন অসুর স্বল্পশক্তিমান নয় এটা আন্দাজ করতে পেরেছিলেন শিব। তাই তিনি বিষ্ণুর সাথে পরামর্শ করতে শুরু করলেন। শ্রীবিষ্ণু মহাদেবকে বলেন, ‘আপনি আমার ডান হাতে আঘাত করে রক্তাক্ত করুন, সেই রক্তে আপনার তেজ মিশিয়ে দিন। এর ফলে আর এক অসুরের সৃষ্টি হবে, যে হবে আপনার ও আমার মিলিত শক্তির অধিকারী। সেই অসুরই একমাত্র শ্বেতজকে পরাজিত করতে পারবে।’ এরপর মহাদেব ত্রিশূল দিয়ে বিষ্ণুর ডান হাতে আঘাত করেন এবং বিষ্ণুর হাত থেকে রক্তপ্রবাহ শুরু হয়। সেই রক্তের ধারার সাথে মহাদেবের তীব্র দৃষ্টি ও বজ্রপাত একীভূত হয়ে উৎপন্ন হল সহস্র বাহুযুক্ত এক বিশাল অসুর, যার নাম দেওয়া হল ‘রক্তজ’। এরপর মহাদেব রক্তজকে আদেশ করেন শ্বেতজের সঙ্গে যুদ্ধ করে তাকে পরাজিত করতে। শুরু হল শ্বেতজ ও রক্তজ-র মধ্যে ভয়ঙ্কর যুদ্ধ। তারা একে অপরকে পরাজিত করার অনেক চেষ্টা করে। কিন্তু বহুকাল থেকে চলতে থাকা এই যুদ্ধে কেউ কাউকে পরাজিত করতে সক্ষম হলেন না। শেষমেশ শ্বেতজ রক্তজের ৯৯৮টি হাত কেটে দেন এবং রক্তজ শ্বেতজের ৯৯৯টি কবচ ভেঙে দেন। এবার ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর একসাথে বুঝতে পারলেন, এভাবে যুদ্ধ চলতে থাকলে মহাজাগতিক প্রলয় সংগঠিত হবে। তাই এই যুদ্ধ এখনই থামিয়ে দেওয়া উচিত।

ব্রহ্মা বললেন, ‘এটা নিশ্চিত যে শ্বেতজ যে কোন সময়ে রক্তজকে হত্যা করতে পারত। কিন্তু সব দিক বিবেচনা করে আপাতত যুদ্ধ থেমে যাক। কিন্তু এই যুদ্ধ তাদের পরের জন্মে আবার শুরু হবে এবং তখন তার পরিণাম ঠিক হবে।’ ব্রহ্মার কথায় রাজি হলেন বিষ্ণু ও শিব। এভাবেই দুই ভয়ঙ্কর অসুরের যুদ্ধ থেমে যায়। শ্বেতজের পুনর্জন্মের দায়িত্ব দেওয়া হয় সূর্যদেবকে এবং রক্তজের পুনর্জন্মের দায়িত্ব দেওয়া হয় ইন্দ্রদেবকে। কিন্তু ইন্দ্রদেব রক্তজের জন্ম-দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করেন। তিনি বিষ্ণুকে বলেন, ‘আপনি এর আগে রাম অবতারে আমার মানসপুত্র বালীকে বধ করেছেন। কিন্তু পরের জন্মে রক্তজ মারা গেলে আমি তার জন্ম দায়িত্ব নেব না।’ ইন্দ্রদেবের কথা শুনে বিষ্ণু তাঁকে গোপনে আশ্বস্ত করলেন ‘আপনি নিশ্চিত থাকুন দেবরাজ, পরের জন্মে আপনার মানসপুত্র রক্তজ, শ্বেতজকে অবশ্যই হত্যা করবে।’ আর এভাবেই পরের জন্মে শ্বেতজ কর্ণ রূপে ও রক্তজ অর্জুন রূপে জন্মগ্রহণ করেন। তাদের পূর্বজন্মের যুদ্ধের ফলাফল মহাভারতের কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে সম্পন্ন হয় একসাথেই, যেখানে অর্জুনরূপী রক্তজ কর্ণরূপী শ্বেতজকে হত্যা করেন।

তবে এই একই কাহিনি হরিবংশ পুরাণে বর্ণিত হয়েছে একটু ভিন্নভাবে-

রামায়ণ যুগের কিষিন্ধ্যার বানর রাজ সুগ্রীব ছিলেন সূর্যদেবের পুত্র! আর তার ভাই মহাশক্তিধর বালি ছিলেন দেবতাদের রাজা ইন্দ্রের পুত্র! বালি এতই শক্তিধর ছিলেন যে, একদিন সন্ধ্যকৃত্য করার সময় ধ্যানমগ্ন অবস্থায় রাক্ষস রাজ্ রাবণ বালির উপর আক্রমণ করে বসেন! কিন্তু বালি ধ্যানমগ্ন অবস্থায় থেকেই নিজের লেজ দিয়ে রাবণ কে ধরে এনে নিজের বাহুতলে ঢুকিয়ে রাখেন! এই বালী কপটতার আশ্রয় করে সুগ্রীবকে সিংহাসন চ্যুত করেছিলেন। আর তাই সুগ্রীব শ্রীবিষ্ণুর অবতার শ্রীরামচন্দ্রের সাহায্য নিয়ে তার সেই মহাশক্তিধর ভাই বালিকে বধ করতে ছল রচনা করেছিলেন! ঐ ছল রচনার রেশ ধরেই সুগ্রীব অভিশাপগ্রস্ত হয়েছিল এবং রামায়ণ যুগ শেষ হওয়ার পর ও মহাভারত যুগ শুরুর আগে তিনি এক রাক্ষস হয়ে জন্ম নিয়েছিলেন! সেই রাক্ষসের নাম ছিল দম্ভোদভব। পূর্ব জন্মে সূর্যপুত্র সুগ্রীব পরজন্মে দম্ভোদ্ভব রূপে সূর্যের পরম ভক্ত ছিলেন। তিনি কঠোর আরাধনা করে সূর্যদেব কে প্ৰসন্ন করে বর হিসেবে সহস্র কবচ সম্বলিত এক মহাশক্তিশালী সুরক্ষা প্রাপ্ত করেছিলেন। সেই কবচ গুলোর বিশেষত্ব ছিল এই যে, কেউ এই সহস্র কবচের শুধুমাত্র একটি কবচ ধ্বংস করতে চাইলে এক হাজার বছর তপস্যার করে আসতে হবে। শুধু তাই নয় দম্ভোদভবের সেই একটিমাত্র কবচ ধ্বংস করার পরিনাম হিসেবে তাঁর জীবনীশক্তি শেষ হয়ে যাবে এবং তাঁর মৃত্যু হবে। মোটকথা দম্ভোদভব যে বর পেয়েছিলেন তা প্রায় অমরত্বের সমান। তাই  হাজার কবচ প্রাপ্তির পর দম্ভোদব রাক্ষস সহস্র কবচ নামে পরিচিত হয়ে উঠলেন! আর এমন বজ্র কঠিন সহস্র কবচের সুরক্ষা পেয়ে স্বাভাবিকভাবে মহা অত্যাচারী হয়ে উঠলেন দম্ভোদভব। দম্ভোদভবের এহেন অত্যাচারে যখন সৃষ্টির ভারসাম্য অস্থিতিশীল হয়ে উঠল তখন দেবাদিদেব মহাদেবের পরামর্শে ভগবান বিষ্ণু দুই অংশে বিভক্ত হয়ে জমজ শিশু রূপে জন্ম নিলেন! তাদের নাম হল নর ও নারায়ণ! নর-নারায়ণের মানবাত্মা হলেন নর এবং দিব্যাত্মা হলেন নারায়ণ। এবং নর ও নারায়ণ উভয়েই ছিলেন স্বয়ং নারায়নের অংশ।

নরনারায়ণ জানতেন হিমালয়ে কেদার নামক পর্বতশৃঙ্গটি মহাদেবের অত্যন্ত প্রিয় এবং বহুকাল আগে থেকেই মহাদেবের আশীর্বাদ ছিল যে, এখানে যদি কেউ একদিন ধ্যান করে সেটা হবে এক হাজার দিন ধ্যানের সমান! একটা সময় নর ও নারায়ণ সেই কেদারশৃঙ্গে গিয়ে মহাদেবের শিষ্যত্ব বরণ করেন এবং মহাদেব কর্তৃক মহামৃত্যুঞ্জয় মন্ত্রের জ্ঞান লাভ করে ধ্যানে লীন হয়ে গেলেন! তাদের এই ধ্যানমগ্ন অবস্থায় কেটে গেল বহুকাল। এক সময় রাক্ষস সহস্র কবচের নিকট সংবাদ পৌঁছাল যে, নর ও নারায়ন নামক দুই ঋষি বহুকাল যাবৎ হিমালয়ের এক পর্বতে ধ্যানমগ্ন হয়ে আছে, এবং তারা এতটাই শক্তি সঞ্চিত করেছে যে, তাদের মন্ত্র উচ্চারণের তেজে পুরো হিমালয় পর্বতমালা প্রকম্পিত হচ্ছে! চিন্তিত হয়ে পড়লেন সহস্রকবচ। তারপর একদিন নর ও নারায়ণের উপর আক্রমণ করে বসলেন তিনি! নর নারয়ণের একজন সহস্রকবচের সাথে একদিন যুদ্ধ করেন, অপরজন সেদিন তপস্যা করে এক হাজার বছরের তপস্যার ফল সঞ্চয় করেন। এভাবে একটি একটি করে কবচ ধ্বংস করতে থাকলেন তারা। এবং প্রতিবার কবচ ধ্বংস করার পর যখন তাদের জীবনী শক্তি শেষ হয়ে যায় তখন একজন আরেক জন কে মহামৃত্যুঞ্জয় মন্ত্রবলে বাঁচিয়ে তোলেন! এভাবে যখন সহস্র কবচের ৯৯৯ টি ধ্বংস হল, তখন সহস্র কবচ পালিয়ে সূর্য দেবের আশ্রয়ে চলে গেলেন! এবং সূর্যদেব তাকে নর ও নারায়নের হাত থেকে রক্ষা করতে তার অবশিষ্ট একটি কবচ সহ দেবী কুন্তীর গর্ভে স্থাপন করে দেন! কুন্তীর সেই পুত্রই হচ্ছেন কর্ণ! যাকে আমরা সূর্যপুত্র কর্ণও বলে থাকি! আর নর নারায়ণ?  তাঁরা আর কেউ নন, নর হলেন কুন্তীপুত্র অর্জুন এবং নারায়ণ হলেন স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ !

আরও পড়ুনঃ  রহস্যময় ও অলৌকিক আদিনাথ মন্দিরের ইতিহাস

দর্শক বুঝতেই পারছেন কর্ণ ও অর্জুন সহোদর হলেও তাদের শত্রুতা এক জন্মের নয়। তবে তাদের বীরত্ব, যোগ্যতা, শক্তি ও সামর্থ্য নিসন্দেহে তুলাদণ্ডে পরিমাপযোগ্য। এবার সেই কঠিন কাজটিই করতে চলেছি আমরা। অর্থাৎ এবার আমরা কর্ণ অ অর্জুনের তুলনামুলক বিশ্লেষণ করব। তবে আপনাদের আবারও মনে করিয়ে দিতে চাই, এখানে কাউকে অহেতুক হেয় প্রতিপন্ন করা বা কাউকে বীর প্রতীয়মান করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। আমাদের উদেশ্য বিভিন্ন পুরাণ ও মহাভারতের ছোট ছোট তথ্যকনিকার দ্বারা এই দুজনের ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিক নির্নয় করা। এবং এরপর শ্রেষ্ঠত্বের বিচার আপনি নিজেই করতে পারবেন।

তো প্রথমেই জেনে নেওয়া যাক অর্জুন সম্পর্কিত কিছু সাধারন তথ্যঃ

মহাভারত অনুসারে জানা যায় অর্জুন ছিলেন দেবরাজ ইন্দ্রের প্রসাদ তথা পান্ডু ও কুন্তীর তৃতীয় পুত্র এবং তৃতীয় পান্ডব। তাকে মহাভারতের যুদ্ধের সর্বশ্রেষ্ঠ বীরদের অন্যতম বলে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। অর্জুন শব্দের অর্থ উজ্জ্বল বা জাজ্বল্যমান। অরিমর্দন, কপিকেতন, কপিধ্বজ, কিরীটী, কৃষ্ণসখা, কৃষ্ণসারথি, কৌন্তেয়, গাণ্ডিবধন্বা, গাণ্ডিবী, গুঁড়াকেশ, চিত্রযোধী, জিষ্ণু, তৃতীয় পাণ্ডব, ধনঞ্জয়, পার্থ, ফল্গুন, ফাল্গুনি, বিজয়, বীভৎসু, শব্দবেধী, শব্দভেদী, শুভ্র, শ্বেতবাহ, শ্বেতবাহন, সব্যসাচী ইত্যাদি নামেও ডাকা হয় তাকে। ব্যাক্তিজীবনে তাঁর ছিল চার স্ত্রী, চার পুত্র ও দুই কন্যা। শ্রীনারায়নের অবতার বাসুদেব শ্রীকৃষ্ণের ভগ্নিপতিও ছিলেন তিনি।

এবার কর্ণ সম্পর্কে কিছু সাধারন তথ্যঃ

কর্ণ ছিলেন পঞ্চপান্ডবের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা ও কুন্তীর প্রথম সন্তান। তিনি বসুসেন, বিজয়ধারী, অঙ্গরাজ এবং রাধেয় নামেও পরিচিত ছিলেন। মাতা কুন্তী ঋষি দুর্বাসাকে সন্তুষ্ট করে বর পেয়েছিলেন যে, তিনি যে কোন দেবতার প্রসাদ নিজের সন্তান হিসেবে পেতে পারবেন। তখন দেবী কুন্তী কুমারী অবস্থায় সুর্যদেবকে আহবান করে কর্ণকে পুত্র হিসেবে পেয়েছিলেন। কিন্তু সমাজের রক্তচক্ষুর ভয়ে তিনি কর্ণকে নদীতে ভাসিয়ে দেন। ভাসমান শিশু কর্ণকে নদী থেকে কুড়িয়ে পেয়েছিলেন অধিরথ ও রাধা দম্পত্তি। এবং তারাই তাকে পুত্রস্নেহে লালল পালন করেন। যেহেতু অধিরথ ছিলেন সূত সম্প্রদায়ের মানুষ তাই কর্ণও সেই সূতপুত্র পরিচয়ে সমাজে নানা রকম বৈষম্যের শিকার হন। হ‌স্তিনাপুর সম্রা‌টের মুকুট যার মাথায় ওঠার কথা, তি‌নি সারা জীবন সূতপুত্র হ‌য়েই  ক‌া‌টি‌য়ে‌ছেন। ব্যাক্তিজীবনে তার ছিল দুই স্ত্রী ব্রশালী ও সুপ্রিয়া এবং তিন পুত্র বৃষসেন, বনসেন ও বৃষকেতু। তিনি ছিলেন অকল্পনীয় শক্তিধর ধনুর্ধর। তাঁর সেই শক্তিকে নিজের স্বার্থে ব্যাবহার করার উদ্দেশ্যে ধূর্ত দুর্যোধন তাকে নিজ পক্ষে অন্তর্ভূক্ত করেন। দুর্যোধনের  মিত্রতার ফাঁদে পা দিয়ে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে তিনি কৌরবদের পক্ষে নিজ ভাই পাণ্ডবদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। কর্ণ সমগ্র জীবনব্যাপী প্রতিকূল ভাগ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন এবং যে কোনো পরিস্থিতিতে তাঁর প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতেন। ধারণা করা হয়, বর্তমান ভারতের হরিয়ানা রাজ্যের কর্নাল শহরটি কর্ণই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কর্ণ তাঁর ত্যাগ, সাহসিকতা, দানশীলতা, বীরত্ব এবং নিঃস্বার্থপরতার জন্য বিখ্যাত হয়ে আছেন।

 আসুন দর্শক শুরু করা যাক অর্জুনের বীরত্ব, পরাক্রম ও ইতিবাচক দিকগুলো দিয়ে।

  • অর্জুন নারায়নের এক অখণ্ড অংশ এবং দেবরাজ ইন্দ্রের ঔরসপুত্র”ছিলেন। অর্থাৎ ‘ভগবান বিষ্ণু ও দেবরাজ ইন্দ্রের’ মিলিত শক্তিতে অর্জুনের উৎপত্তি, তাই স্বভাবতই অর্জুন অসীম শক্তির অধিকারী।
  • অর্জুন ছিলেন’গুরু দ্রোণের’ সবচেয়ে প্রিয় শিষ্য এবং সেই সাপেক্ষে গুরু দ্রোণ তাঁকে “ব্রহ্মাস্ত্র ও ব্রহ্মাস্ত্রের থেকে চারগুন শক্তিশালী ব্রহ্মশির অস্ত্র” দান করেছিলেন। এছাড়াও অসংখ্য অস্ত্র ছিলো অর্জুনের অস্ত্র ভান্ডারে যা বলে শেষ করা সম্ভব নয়। মহাভারতের শেষভাগে পান্ডবদের সমস্ত বংশপ্রদীপকে নাশ করার উদ্দেশ্যে অশ্বত্থামা ব্রহ্মশির অস্ত্র প্রয়োগ করলে অর্জুনকেও বাধ্য হয়ে ব্রহ্মশির অস্ত্র প্রয়োগ করতে হয়, কিন্তু অর্জুন তা ফিরিয়ে নিতে সক্ষম ছিলেন যা অশ্বত্থামা পারতেন না।
  • অর্জুন’সব্যসাচী’ ছিলেন অর্থাৎ তার দুই হাত সমান রূপে দক্ষ এবং তিনি রাত্রি বেলাতেও সমান দক্ষতায় যুদ্ধ করতেন। এছাড়াও অর্জুন সকল প্রকার অস্ত্র-শস্ত্র চালনা, সকল প্রকার ব্যূহ রচনা ও ধ্বস্ত করার বিদ্যা জানতেন।
  • দ্রুপদের বিরুদ্ধে দুর্যোধন যখন তার ভ্রাতাগন, কর্ণ ও সেনা সহ পরাজিত হয় তখন অর্জুন কেবল ভীম, নকুল ও সহদেব কে সাথে নিয়েই দ্রুপদকে বন্দী করে আনেন। উল্লেখ্য, এই সময় কর্ণ তার কবচ-কুন্ডল সহ দ্রুপদের কাছে পরাজিত হন কিন্তু অর্জুন তাকে পরাজিত ও বন্দি করেন গান্ডীব ধনুক, অক্ষয় তুন ও কপিধ্বজ রথ ছাড়াই। 
  • অর্জুনঅগ্নিদেব কর্তৃক বরুন্দেবের গাণ্ডীব ধনুক, অক্ষয় তূণ এবং কপিধ্বজ নামের আশ্চর্য রথ” উপহার পেয়েছিলেন। বলা হয় এই গান্ডীব ধনুকের তীর কখনো শেষ হত না। এছাড়াও মহাবিনাশী এই অস্ত্রের ছিল আশ্চর্য শত্রু নাশ করার ক্ষমতা। পরবর্তীতে পান্ডবদের স্বর্গারোহনের সময় এই গাণ্ডীব ধনুক অর্জুন পুনরায় বরুণদেবকে ফেরত দেন। বলা হয় কলিকালের শেষে কল্কি অবতার যে সকল অস্ত্র নিয়ে মর্ত্যে আবির্ভূত হবেন তার মধ্যে একটি হবে এই গাণ্ডীব।
  • দ্রৌপদীর স্বয়ংবরে অর্জুন উপস্থিত সকল ক্ষত্রিয়বর্গকে পরাজিত করেন। কিন্তু অর্জুন তখনও গান্ডীব ধনুক, অক্ষয় তুন ও কপিধ্বজ রথ লাভ করেননি।
  • অর্জুন নাগ কন্যাউলুপিকে বিবাহ করে বরদান লাভ করেন যার ফলে তিনি জলে অজেয় হন এবং সকল জলচর জীবের ওপর তার আধিপত্য হয়।
  • অর্জুন শুধুমাত্র দক্ষ তীরন্দাজ ছিলেন তাই নয়। তাঁর বাহুবলও ছিল অতুলনীয়। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যখন ভীম ও অর্জুনকে সঙ্গে নিয়ে যখন মগধ সম্রাট’জরাসন্ধের’ কাছে ব্রাক্ষণ বেশে যান তখন তিনি জরাসন্ধ কে মল্লযুদ্ধের জন্য তাদের তিন জনের মধ্যে যে কোনো একজনকে বেছে নিতে বলেন। অর্থাৎ ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অর্জুনের বাহুবলের ওপরও সম্পুর্ণ আস্থা ছিলো।
  • অর্জুন তপস্যা দ্বারা মহাদেবকে প্রসন্ন করে মহাবিনাশী এবং ভয়াবহ মারণাস্ত্র ‘পাশুপাত অস্ত্র’ লাভ করেন। এটি একটি অর্ধচন্দ্রাকৃতি বিধংসী অস্ত্র, যেটি মন, চোখ, কথা অথবা ধনুকের দ্বারা নিক্ষেপ করা যায়। পাশুপতাস্ত্র নিক্ষেপিত হলে সমস্তকিছু ধ্বংস করে বিপক্ষের পরাজয় অবসম্ভাবী করে তোলে। কিন্তু অর্জুন কখনোই পশুপাতাস্ত্র প্রয়োগ করেননি।
  • দ্রৌপদী ও অন্যান্য ভাইদের সঙ্গে বনবাসে থাকাকালীন অর্জুন কিছুদিন তার পিতা ইন্দ্রের কাছে তিনি অস্ত্রশিক্ষা করেন এবং পরবর্তীকালে গুরুদক্ষিণা বাবদ ইন্দ্রের শত্রু তিন কোটি নিবাতকবচগণকে তাদের সমুদ্রস্থিত দুর্গ সহ ধবংস করেন। কালকেয় প্রভৃতি অসুরদেরও অর্জুন ধবংস করেছিলেন। তাই ইন্দ্র সন্তুষ্ট হয়ে তাকে দিব্যকিরীট, হিরণ্ময়ী মালা, অভেদ্য দিব্যকবচ, দেবদত্ত শঙ্খ ইত্যাদি উপহার দেন। উল্লেখ্য নিবাতকবচগন ছিলেন এক ধরনের দুর্ধর্ষ অসুর। সুতলের নিচে তলাতল, তলাতলের নিচে মহাতল এবং মহাতলের নিচে রসাতল নামক স্থানে নিবাতকবচগণ বাস করতেন। তারা জাদু, মায়া ও যুদ্ধে বিশেষ পারদর্শী ছিলেন। তারা এমন একটি কবচ বা সুরক্ষা দ্বারা সুরক্ষিত ছিলেন, যেখানে যেতে হলে বায়ুশূন্য স্থান অতিক্রম করে যেতে হয়। দেবরাজ ইন্দ্র বহু চেষ্টা করেও তাদের পরাজিত করতে পারেন নি। এমনকি রামায়নে স্বয়ং রাবণ তাদের যুদ্ধে হারাতে না পেরে শেষে তাদের সঙ্গে সন্ধি করেন।
  • পান্ডবদের বনবাস কালে দুর্যোধন গন্ধর্বদের দ্বারা বন্দি হলে কর্ণ কিন্তু তাকে রক্ষা করতে পারেননি, তখন অর্জুনই গন্ধর্বদের পরাজিত করে দুর্যোধন কে মুক্ত করেন।
  • বিরাট যুদ্ধে অর্জুন’মোহিনী অস্ত্রের’ প্রয়োগ করে একাই ভীষ্ম, দ্রোণাচার্য, কর্ণ সহ সকল কৌরব সৈন্য কে পরাজিত করেন।
  • অর্জুন মহাভারতের অন্যতম মহাবীর পিতামহ ভীষ্ম কে সরশয্যা প্রদান করেন। এছাড়াও ভগদত্ত ও সুশর্মা সহ সংশপ্তকদেরকেও অর্জুন একাই পরাজিত করেন।
  • অর্জুনের বীরত্ব সম্পর্কে তাঁর গুরু স্বয়ং দ্রোণাচার্য দুর্যোধন কে বলেন যে তিনি অর্জুন কে পার করে যুধিষ্ঠির কে বন্দি করতে পারবেন না, সেই কারনে তিনি অর্জুন কে যুদ্ধ থেকে সরিয়ে তারপর চক্রবূহ রচনা করেন।
  • মহাভারতের যুদ্ধের চতুর্দশ তম দিনে অর্জুন কৌরব সেনার এমন ভয়াবহ বিনাশ করেন যে তা দেখে যুধিষ্ঠির বলেন”বোধ হয় অর্জুন বীরগতি প্রাপ্ত হয়েছে আর তার জায়গায় স্বয়ং কেশব যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছেন, তিনি হয়তো আজই এই যুদ্ধ সমাপ্ত করে দেবেন তাই এই মহাবিনাশ।”বস্তুত সেদিন রণাঙ্গনে অর্জুন এক মহাবিনাশী রূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন যে রূপ আগে কেউ কখনো দেখে নি।
  • সিন্ধু রাজ জয়দ্রথ যখন পঞ্চপান্ডবদের পরাজিত করার উদ্দেশ্যে মহাদেবের কাছে বর প্রার্থনা করেন তখন মহাদেব তাকেএকদিনের জন্য অর্জুন বাদে জগতের সকল যোদ্ধার বিরুদ্ধে অজেয় হওয়ার বর দেন। কারন অর্জুনের সমান বা অর্জুনের থেকে বেশী শক্তি প্রদান করা স্বয়ং মহাদেবের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। এর থেকে বোঝা যায় অর্জুন কি বিরাট রকমের শক্তিশালী যোদ্ধা ছিলেন।
  • এবং সর্বশেষ, যুধিষ্ঠিরের অশ্বমেধ যজ্ঞের সময় অর্জুন দিগ্বিজয় করেন।
আরও পড়ুনঃ  অশ্বমুণ্ডধারী হয়গ্রীব অবতার কে? || শ্রীবিষ্ণুর মাথা কা *টা গেল কেন? || পৌরাণিক কাহিনী ||

 

এবার দেখে নেওয়া যাক কর্ণের বীরত্ব, পরাক্রম ও ইতিবাচক দিকগুলো

  • কর্ণ’সূর্যপূত্র’ ছিলেন, সেই কারনে অত্যন্ত তেজস্বী যোদ্ধা ছিলেন। তিনি তাঁর জন্মের সময় সূর্যতেজ সম্পন্ন দিব্য কবচ ও কুন্ডল সহ জন্ম গ্ৰহন করেছিলেন। 
  • অর্জুন ছি‌লেন দ্রোণাচা‌র্যের শিষ্য। আর দ্রোণাচার্য ছি‌লেন ভগবান পরশুরা‌মের শিষ্য। অন্যদিকে কর্ণ ছি‌লেন স্বয়ং পরশুরা‌মের শিষ্য। সুতারাং অর্জুনের গুরুর গুরুর কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহন করেছিলেন কর্ণ। পরশুরাম তাকে ব্রহ্মাস্ত্র, আগ্নেয়াস্ত্র, বরুনাস্ত্র, নাগাস্ত্র, ভার্গবাস্ত্র ও একপুরুষঘাতিনী অস্ত্রের মতো বহু শক্তিশালী অস্ত্র দান করেছিলেন।
  • কর্ণের অস্ত্রভান্ডারে অন্যতম শ্রেষ্ঠ অস্ত্র ছিল বিজয় ধনুক। পরশুরামের কাছে অস্ত্রশিক্ষা করার সময় তিনি যেমন ছলনা করার জন্য তাকে অভিশাপ দিয়েছিলেন, তেমনি তার পরিশ্রম, একাগ্রতা ও গুরুভক্তিতে সন্তুষ্ট হয়ে তাকে বিজয় ধনুক নামের এক অজেয় অস্ত্র দান করেছিলেন যার টঙ্কারে ওঠে মেঘমন্দ্র গর্জন। এই ধনুক যার কাছে থাকে তাকে পরাজিত করা অসম্ভব। 
  • দাতা হিসেবে আজও মানুষের মনে ভাস্বর হয়ে আছেন দাতা কর্ণ। তিনি তাঁর রক্ষাকবচটিকে পর্যন্ত ইন্দ্রদেবকে দান করেছিলেন এবং বিনিময়ে তিনি ইন্দ্রের কাছ থেকে অমোঘ বৈজয়ন্তী অস্ত্র বা একাঘ্নী অস্ত্রলাভ করেন।
  • দুর্যোধনের স্ত্রী ভানুমতী তাঁর স্বয়ম্বর সভায় দুর্যোধনকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। এই অপমানে প্রতিশোধ নিতে দুর্যোধন ভানুমতীকে হরন করেন। উল্লেখ্য ভানুমতীকেহরনের সময় কর্ণ একাই সকল ক্ষত্রিয়বর্গকে পরাজিত করেছিলেন।
  • দুর্যোধনেরবৈষ্ণব যজ্ঞের সময় কর্ণ দুর্যোধনের জন্য দিগ্বিজয় করেন।
  • মহাবলিঘটোৎকচক ছিলেন ভীম ও হিড়িম্বার পুত্র। বিরাটকায় এবং মহাশক্তিশালী এই যোদ্ধাকে বাসবী শক্তি তথা একাঘ্নী অস্ত্র অথবা মতান্তরে বৈজয়ন্তী অস্ত্র প্রয়োগ বধ করেছিলেন কুন্তীপুত্র কর্ণ।
  • পাণ্ডবপক্ষের সবচেয়ে বলশালী যোদ্ধা ছিলেন ভীম। এই ভীমকেও কর্ণ যুদ্ধে পরাজিত করেছিলেন। বলাই বাহুল্য ভীম ছাড়াও তিনি অন্যান্য মহাবলী পান্ডব তথাযুধিষ্ঠির, নকুল ও সহদেবকে পরাজিত করেছিলেন।
  • নি‌জের শ‌ক্তি ও সামর্থই ছিল অর্জু‌নের একমাত্র সুরক্ষা ব্যবস্থা। উপরন্তু, শ‌ক্তি ও সার্ম‌থ্যের সা‌থে ক‌র্ণের ছিল সূর্য‌দে‌বের দেওয়া কবচ ও কুন্ডল । যার কার‌ণে কোন দেব, দানব, যক্ষ, রক্ষ, মানুষ্য কা‌রো প্রহারই তার দেহ ভেদ কর‌তে পারত না।
  • কর্ণপুত্র বৃষ‌সেনও ছিলেন বীর যোদ্ধা। কুরু‌ক্ষেত্রের যু‌দ্ধে অর্জু‌নের বাণ যখন কৌরব‌সেনা‌দের ম‌ধ্যে ভ্রম সৃ‌ষ্টি কর‌ছিল, যখন পিতামহ ভীষ্ম ও দ্রোণাচার্য যখন সেই অস্ত্র নি‌স্ক্রিয় করার অবকাশ খুঁজে পা‌চ্ছি‌লেন না, ঠিক তখনই কর্ণ পুত্র বৃষ‌সেন মহাপরাক্রম দে‌খি‌য়ে সেই অস্ত্র ‌নি‌স্ক্রিয় ক‌রেন। যার প্রয়োগ তি‌নি নিজ পিতা ক‌র্ণের নিকট থে‌কে শি‌খে‌ছি‌লেন।
  • মৃ‌ত্যেুর আগে কর্ণ কর‌জো‌ড়ে শ্রীকৃ‌ষ্ণের নিকট মিন‌তি ক‌রে বলেছিলেন, হে মাধব, জীবনভর আমি দান ক‌রে‌ছি, ধনু‌র্বিদ্যায় শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন ছিল আমার জীব‌নের চুড়ান্ত লক্ষ্য। কিন্তু সারাটা জীবন আমি সমা‌জে অব‌হে‌লিত, অপমা‌নিত হয়েছি, ক্ষ‌ত্রিয় হ‌য়েও সূতপু‌ত্রের ন্যায় জীবন কা‌টি‌য়ে‌ছি, হে মাধব আজ অন্তিম ল‌গ্নে আপনার কাছে আমার একটাই প্রশ্ন, সমাজ কি কখ‌নোই আমার সাম‌র্থের মূল্যায়ন কর‌বে না? শ্রীকৃষ্ণ বল‌লেন, মিত্র ,  আজ যখন আপনার র‌থের চাকা মা‌টি‌তে বসা, আপনার বিদ্যা আপনার সঙ্গ দি‌চ্ছে না, আপনার হা‌তে কোন অস্ত্র নেই, আপ‌নি নিরস্ত্র। এমন সু‌যো‌গের সদ্বব্যবহার ক‌রে অর্জুন আপনা‌কে বধ করছে, তবুও কি সমাজ বুঝ‌বে না আপনার সাম‌র্থের গুরুত্ব?

 

এবার আসুন জেনে নেওয়া যাক অর্জুনের নেতিবাচক দিকগুলোঃ

  • অর্জুন নিজের আস্ত্রবিদ্যা নিয়ে খুবই গর্বিত ছিলেন। এবং তিনি নিজেকে আর্যাবর্তের শ্রেষ্ঠ ধনুর্বিদ মনে করতেন।
  • ছোটবেলাতেই একলব্যের আঙ্গুল কেটে নেওয়ার ঘটনায় তার ভুমিকা ছিল। তিনি তার গুরু দ্রোণাচার্যকে এই বলে প্ররোচিত করেছিলেন যে, হে গুরুদেব আপনি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে, তোমার থেকে আমার অন্য কোনো শিষ্যই উৎকৃষ্ট হবে না, কিন্তু এখন তো এর বিপরীত জিনিস দেখা যাচ্ছে। নিষাদপতির পুত্র মহাবল একলব্য আপনার এক শিষ্য, এবং সে ধনুর্বিদ্যায় আমার থেকেও অনেক বেশি শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করেছে! এই প্ররোচনায়, গুরু দ্রোণ একলব্যের বৃদ্ধাঙ্গুলি কর্তন করে গুরুদক্ষিণা হিসেবে দাবী করেছিলেন।
  • কর্ণের বিশেষ ভূমিকায় নিজের পুত্র অভিমন্যুর করুন মৃত্যুতে অর্জুন অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। এছাড়াও অভিমন্যুর মৃত্যুতে কর্ণ পুত্র বৃষসেন দায়ী ছিলেন। তাই তিনিও বালক বৃষসেনকে পরাজিত ও নিহত করেছিলেন। এত বড় মহাবীর হয়ে নিতান্ত বালকের উপর প্রহার করা তার চরিত্রকে কিছুটা অনুজ্বল করেছে।
  • দ্রৌপদীর পাচ স্বামীর মধ্যে অর্জুনকে তিনি বেশী ভালোবাসতেন। কিন্তু অর্জুন দ্রৌপদীর ভালবাসাকে উপেক্ষা করে সুভদ্রাকেই সবচেয়ে বেশী ভালোবাসতেন।
  • যেদিন অর্জুন কর্ণকে বধ করলেন সেদিন পান্ডব শিবিরে বইছে খুশির হাওয়া। সেই রাত্রিতে পান্ডব শিবিরে একটি বিশেষ কক্ষে শ্রীকৃষ্ণ এবং অর্জুনের একান্তে আলাপচারিতায় অর্জুনের কন্ঠে ফুটে ওঠে অহংকারের ছাপ।উল্লাসে মত্ত অর্জুন শ্রীকৃষ্ণকে বললেন সখা ত্রিভুবনে আজ আমার সমকক্ষ কেউই নেই।আমার সামনে কর্ণের প্রতিরোধ খড়কুটোর মতোই উড়ে গেল।স্মিত হাসলেন শ্রীকৃষ্ণ। অর্জুন বলে চললেন, কর্ণ কথায় কথায় তার বীরত্বের বড়াই করত।কিন্তু আজ সূতপুত্রের সব দর্প আমি চূর্ণ করে দিয়েছি। এরপর অর্জুন খেয়াল করলেন শ্রীকৃষ্ণ কোন কথারই কোন উত্তর দিচ্ছেন না। বিষ্মিত হলেন অর্জুন, বললেন কি ব্যাপার সখা।আপনি আজ নিশ্চুপ কেন?আপনি কি আজ আমার বীরত্বের পরিচয় পাননি? ভেবে দেখুন লড়াইয়ের সময় আমার এক বাণে কর্ণের রথ দশ পা পিছিয়ে যাচ্ছিল,আর সেখানে কর্ণের এক বাণে আমার রথ মাত্র দুই পা পিছনে যাচ্ছিল।এখানেই কি বোঝা যায় না যে অর্জুনই শ্রেষ্ঠ? ‘না’ দৃঢ় কণ্ঠে জবাব দিলেন শ্রীকৃষ্ণ। কর্ণকে তুমি হারিয়েছ এর মানে এই নয় যে কর্ণ একজন শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা ছিলেন না। ভ্রূ কুঁচকে গেল অর্জুনের,কি বলতে চান আপনি কেশব? শ্রীকৃষ্ণ বললেন দেখো পার্থ পিতামহ ভীষ্ম তোমার সামনে যুদ্ধে নিষ্ক্রিয় হয়ে ছিলেন, তার মানে কি তুমি পিতামহ ভীষ্মের চেয়েও বড় ধনুর্ধর হয়ে গেলে? অর্জুন বললেন না প্রভু পিতামহ ভীষ্মের কথা আলাদা। হাসলেন শ্রীকৃষ্ণ হে পার্থ তুমি আমার প্রিয় মিত্র।পরম সুহৃদ।এই পৃথিবীতে আর কেউ না জানুক তুমি তো জানো আমি কে? তোমার কাছে তো আমি কিছুই গোপন করি নি।এমনকি নিজের দিব্য রূপও দেখিয়েছি তোমাকে। করজোড়ে আনতমুখে বললেন অর্জুন হ্যাঁ প্রভু আমি জানি আপনি কে। শ্রীকৃষ্ণ বললেন, তাহলে ভেবে দেখো অর্জুন তোমার রথের ওপর যেখানে স্বয়ং আমি বসে আছি ত্রিলোকের ভার নিয়ে সেই রথকে কি কেউ বিন্দুমাত্রও পিছনে হঠাতে পারে? এবারে তুমি নির্ণয় করো পার্থ কার বাণে অধিক শক্তি ছিল?খানিকটা ভাবনায় পড়লেন অর্জুন।এভাবে তো তিনি ভেবে দেখেননি।বলে চললেন শ্রীকৃষ্ণ তাছাড়া তুমি কর্ণকে হারাওনি অর্জুন।কর্ণকে হারিয়েছে তার কর্মফল। মানে? একটু অবাক হলেন অর্জুন।মনে করে দেখ অর্জুন ব্রাহ্মণ পরিচয় দিয়ে পরশুরামের কাছে অস্ত্রবিদ্যা শিখতে গিয়েছিলেন কর্ণ।কিন্তু একদিন কর্ণের আসল পরিচয় ফাঁস হয়ে যায় পরশুরামের কাছে ।তখনই পরশুরাম তাকে শাপ দেন যুদ্ধক্ষেত্রে মহাবিপদকালে কর্ণ সব অস্ত্রের নাম ও সংকেত ভুলে যাবে।তাছাড়া ভুলক্রমে এক ব্রাহ্মণের গরু মেরে ফেলাতে তিনিও শাপ দিয়েছিলেন মৃত্যুকালে তার রথের চাকা মাটিতে বসে যাবে। তুমি তো নিমিত্তমাত্র অর্জুন। কর্ণ তার নিজের দোষেই আজ হত। কিন্তু তার মহত্বকে, তার বীরত্বকে কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। তুমি জানো না পার্থ, কর্ণ কৌরবপক্ষের সেনাপতি হওয়ার পর আমি তার শিবিরে গিয়েছিলাম কর্ণকে পাণ্ডবপক্ষে আসার নিমন্ত্রণ দিতে,ধর্মপক্ষে আসার সুযোগ দিতে।কিন্তু কর্ণ বলেছিলেন যতই দুর্যোধন অধর্মের পথে থাকুক, কিন্তু বিপদের দিনে সে আমাকে আশ্রয় দিয়েছে। অতএব সেই মিত্রতার ঋণ শোধ করাই হবে তার প্রথম ধর্ম। কর্ণ এও বলেছিলেন এই যুদ্ধে জয় পাণ্ডবদেরই হবে কিন্তু তাই বলে তিনি দুর্যোধনকে ধোঁকা দিতে পারবেন না। তিনি প্রাণ দিয়ে দেবেন তবু কৌরবপক্ষ ছাড়বেন না। আর কর্ণ তাই করলেন, প্রাণ দিয়ে যেমন দুর্যোধনের মিত্রতার ঋণ শোধও করলেন তেমন ধর্মের বিজয়ের পথও প্রশস্ত করে দিলেন। হে পার্থ যদি কোনোদিন কর্ণের জীবনের পূর্ণ কথা জানার সুযোগ পাও তাহলে তুমি মাটিতে শুয়ে ওকে প্রণাম করবে।
আরও পড়ুনঃ  কুম্ভমেলার ইতিহাস ও অজানা তথ্য

 

এবার আসুন কর্ণের নেতিবাচক দিকগুলো দেখে নেওয়া যাকঃ

  • পরশুরামের কাছে গিয়ে মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে ধনুর্বিদ্যার শিক্ষা লাভ করেন। তিনি যথেষ্ট পরিশ্রমী ও অধ্যবসায়ী হওয়ার কারনে পরশুরামের অন্যতম প্রিয় শিষ্য হয়ে ওঠেন। এরপর পরশুরাম যখন তার সত্য পরিচয় জানতে পারেন তখন তিনি তাকে অভিশাপ দেন এই বলে যে, জীবনের সংকটময় পরিস্থিতিতে তার বিদ্যা কোনো কাজে আসবে না।
  • দ্রৌপ্রদীর স্বয়ংবর সভায় দ্রৌপ্রদী কর্ণকে শূতপুত্র বলে আখ্যায়িত করেছিল বলে কর্ণের দ্রৌপ্রদীর প্রতি এক বিশেষ ক্ষোভ আর ঘৃণা ছিল। কিন্তু তাই বলে তিনি দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের ঘটনায় যে বিতর্কিত আচরন করেছিলেন তা সকলকে আহত করে। তার ঈশারাতেই দুঃশাসন দ্রৌপ্রদীকে সভায় বস্ত্রহীন করতে আসেন। এছাড়াও কর্ণ দ্রৌপদীকে গণিকা নামেও সম্বোধন করেছিলেন।
  • কর্ণের দানশীলতা জগৎ বিখ্যাত। কিন্তু তার কিছু দানের সাথে স্বার্থের ছোঁয়াও অনুভব করা যায়। যুদ্ধপ্রস্তুতি চলাকালীন যখন দেবরাজ ইন্দ্র ব্রাহ্মণবেশে কর্ণের কাছে তার কবচ আর কুণ্ডল দান হিসেবে ভিক্ষা করেন তখন কর্ণ নিঃসংকোচে নিজের দেহ থেকে তা আলাদা করে দেবরাজের হাতে তুলে দেন। এই ঘটনা কর্ণের দানশীলতা ও উদার মনের পরিচয় দেয়। কিন্তু এর পরে বাকী একটি ঘটনা আমাদের অলক্ষ্যে চলে যায়। কর্ণের দানের এই মহান ঘটনা দেখে দেবরাজ নিজেই কর্ণকে বর চাইতে বলেন। আর কর্ণ নিজের মনমত বর ইন্দ্রের সেই একাঘ্নী অস্ত্র কিন্তু চেয়ে নেন অর্জুনকে বধ করার জন্য। এখানে বলা যেতে পারে অঙ্গরাজ কর্ণ পরোক্ষভাবে তার দানের প্রতিদান গ্রহন করেছিলেন। এবং এই অস্ত্র দিয়েই তিনি মহাবলশালী ঘটৎকচকে বধ করেছিলেন।
  • এবার আসি অভিমন্যুর মৃত্যুদিনের ঘটনায়। অভিমন্যু চক্রব্যূহে ঢুকতে জানতেন, কিন্তু কিভাবে সেখান থেকে বেরোতে হয় সেটা জানতেন না। তবে বয়স যাই হোক না কেন শক্তি আর সামর্থ্যে অভিমন্যু ছিলেন অর্জুনের সমতুল্য। গুরু দ্রোণ যখন রণক্ষেত্রে চক্রবূহ্য রচনা করেছিলেন সেদিন কুরুক্ষেত্রে অর্জুন অনুপস্থিত ছিলেন। তাই বাধ্য হয়ে পান্ডবগন অভিমন্যুকে এই বুহ্য ভেদ করতে পাঠান। অভুমন্যু বুহ্য ভেদ করে শত্রুপক্ষকে ছিন্নভিন্ন করতে শুরু করলেন। অভিমন্যুকে অপ্রতিরোধ্য দেখে দ্রোণের উপদেশে কর্ণ তাকে পিছন থেকে আক্রমণ করে তাকে রথচ্যূত ও ধনুর্হীন করেন এবং দ্রোণ, কৃপ, কর্ণ, অশ্বত্থামা, দুর্যোধন ও শকুনি নিষ্করুণ ভাবে তার ওপর শরাঘাত করতে থাকেন। অভিমন্যু খড়গ, চক্র, গদা এমনকি রথের চাকা দিয়ে আত্মরক্ষার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। অভিমন্যু সামান্য বালক ও নিজের ভ্রাতুষ্পুত্র জানার পরেও কর্ণ যুদ্ধক্ষেত্রে তার করুণ মৃত্যুর পথ সুগম করেছিলেন। এবং এরই ফলশ্রুতিতে অর্জুনের হাতে কর্ণের পুত্র বৃষসেন নিহত হন।
  • এবার আসি সেই বিশেষ ঘটনায় যখন কর্ণ-অর্জুনের সম্মুখসমরের সেই বিশেষ দিন চলে আসে। অর্জুন আর কর্ণের যুদ্ধ যখন ভয়াবহ রুপ ধারণ করে তখন অর্জুন অস্ত্রাঘাতে কর্ণের রথের চাকা আলাদা করে দেন। অস্ত্রের আঘাতে কর্ণও দুর্বল হয়ে পড়েন। এই অবস্থায় অর্জুন কর্ণকে বধ করতে চাননি। তাই তিনি অস্ত্রের প্রয়োগ সাময়িকভাবে বধ রাখেন। কিন্তু কর্ণ যখন স্বাভাবিক হন তখনই তিনি এক শক্তিশালী অস্ত্র ছুড়ে অর্জুনকে মূর্ছিত করে দেন। এরপর ব্রহ্মাস্ত্রের প্রয়োগ করতে শুরু করেন তিনি। কিন্তু পরশুরামের দেওয়া অভিশাপে সেটা তার স্মরণে আসে নি। এদিকে মুর্ছিত অর্জুন যখন জ্ঞান ফিরে পেয়ে কর্ণকে ব্রহ্মাস্ত্র আহবান করার চেষ্টা করতে দেখলেন তখন তিনি অঞ্জলি অস্ত্র দ্বারা কর্ণকে বধ করেন। অঞ্জলি অস্ত্রের প্রয়োগের সাথে সাথেই কর্ণের শিরচ্ছেদ হয়ে যায়।

প্রিয় দর্শক, এই লেখাটিতে শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা, মহাভারত, বিভিন্ন পুরাণের ও কিছুটা উপকথার আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল কর্ণ ও অর্জুন সম্পর্কে সমস্ত খুঁটিনাটি তথ্য আপনাদেরকে জানানো। সে উদ্দশ্য কতটুকু সফল হল তা অবশ্যই আপনাদের বিবেচ্য। তাছাড়া কর্ণ ও অর্জুনের মধ্যকার শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইয়ে কাউকে ছোট বড় করে দেখার ধৃষ্টতা আমাদের নেই। সেই দায়ভার বরং আপনাদের কাধেই থাকুক। তবে যেহেতু পৌরাণিক এই কাহিনীগুলো বিভিন্ন পুস্তকের সংস্করনের মাধ্যমে এবং বিভিন্ন অনুবাদকের হাত ধরে আজ পর্যন্ত চলে এসেছে সেখানে ছোট খাট ত্রুটি বিচ্যুতি থাকা মোটেও অস্বাভাবিক নয়। এহেন অনিচ্ছাকৃত ভুলত্রুটির জন্য সনাতন এক্সপ্রেস আপনাদের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী। তবে লেখাটি কেমন লাগল এবং আপনার মতে এই দুই যোদ্ধার মধ্যে শ্রেষ্ঠ কে তা অবশ্যই আমাদেরকে কমেন্ট করে জানাবেন।

5/5 - (1 vote)

Leave a Reply