দেবালয় বা মন্দিরে গেলেই স্বাভাবিকভাবেই মানুষের হৃদয় ভরে ওঠে পবিত্রতা ও স্নিগ্ধতায়। দৈবিক আবহে দেহ মন ছুয়ে যায় আধ্যাত্মিকতার শীতল স্পর্শ। কিন্তু সব মন্দিরেই কি এই একই ঘটনা ঘটে? নাকি কোন কোন মন্দিরে দৈবিক আবহকে ছাড়িয়ে যায় অন্য কিছু? যেমন ধরুন, ভৌতিক পরিবেশ বা অশরীরী কোণ কিছুর উপস্থিতি? হ্যাঁ, আপনি আমি এরকম পরিত্যাক্ত, ভুতুড়ে বা অভিশপ্ত মন্দিরের কথা হয়ত অনেক শুনেছি। কিন্তু এমন কোন মন্দিরের কথা শুনেছেন যেখানে সুর্যাস্তের পর প্রবেশ করলেই পাথরে পরিনত হয় মানুষ? বলছি রাজস্থানের খাজুরাহো নামে খ্যাত কিরাডু মন্দিরের কথা। আসুন আমরাও দেখে আসি হাজার বছরের প্রাচীন জনমানবহীন এক রহস্যময় মন্দির আর তার আশেপাশে পড়ে থাকা প্রাচীন পাথরগুলোর দীর্ঘশ্বাস।
ভারতবর্ষ হল এমন দেশ যেখানে জীবন ও রহস্য যেন ওতোপ্রতোভাবে জড়িত। তাই তো এদেশের অলিগলিতে কান পাতলে এমন রহস্য মাখা অনেক গল্প শুনতে পাওয়া যা বাস্তবিকই রোমহর্ষক। কথায় আছে মরু শহরের বুকে এমন অনেক কেল্লা, এমন অনেক গ্রাম রয়েছে যেখানে সন্ধ্যার পর পা দেওয়া মৃত্যুর সমান। ঠিক তেমনি রহস্যে মোড়া রাজ্য রাজস্থান! রাজপথ থেকে অলিতে-গলিতে, কোটি কোটি রহস্য লুকিয়ে রয়েছে প্রতিটি বালুকণায়! এমনকি বিশেষজ্ঞরাও আজও কিনারা করতে পারেননি এ রাজ্যের বহু স্থাপত্য রহস্যর! যেমন ধরুন কিরাডু মন্দির।
একে মরু-ঘেঁষা এক ভূপ্রকৃতি, তার উপরে শুকনো হাওয়ার দীর্ঘশ্বাস। দিনের বেলাতেই কিরাডু কেমন যেন গা-ছমছমে। মন্দিরে প্রবেশের সদর দরজা জং ধরে বহুকালই বন্ধ। এমনিতে তার সঙ্গে ১১-১২ শতকের অন্য মন্দির গুলির চেহারার বিশেষ পার্থক্য নেই। খাজুরাহো মন্দিরের সঙ্গে তার এতটাই মিল যে, তাকে অনেকেই তাকে ‘রাজস্থানের খাজুরাহো’ বলে ডাকেন। রাজস্থানের মরুভূমি-ঘেঁষা শহর বারমের থেকে ৩৫ কিমি দূরে অবস্থিত কিরাডু মন্দির। কিন্তু এই মন্দিরটি তার আশ্চর্য স্থাপত্যের জন্য যতটা না বিখ্যাত, তার থেকেও বেশি মাত্রায় তার খ্যাতি অন্য এক ব্যাপারে। সোলাঙ্কি রীতির স্থাপত্যের এই মন্দিরে রাত্রিযাপনের কথা নাকি কেউ স্বপ্নেও ভাবতে পারেন না।
স্থানীয় বাসিন্দাদের বক্তব্য অনুযায়ী সন্ধ্যার পর এই মন্দিরে প্রবেশ করা নিষেধ। প্রাচীনকাল থেকেই এই মন্দিরটি অভিশপ্ত হওয়ায় এখানে সুর্যাস্তের পর প্রবেশ করলে সঙ্গে সঙ্গে পাথর হয়ে যায় মানুষ। মানে মৃত্যু নিশ্চিত। বারমের থেকে প্রায় ৩৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত “কিরাদকোট” নামে পরিচিত এই পাঁচটি মন্দিরের সমষ্টি এক সময় বেশ জনপ্রিয় ছিল তার শরীরে খুদিত কারুকার্যের জন্য। তাই তো এই মন্দিরটিকে রাজস্থানের খাজুরাহো বলেও ডাকা হয়ে থাকতো। কিন্তু এক ভয়ংকর অভিশাপে শাপিত হয়ে বর্তমানে বিধবার মতো পড়ে রয়েছে মন্দিরগুলি। রাতে তো ছাড়ুন, দিনেও কারও দেখা পাওয়া যায় না এখানে। এমনকি যে হাতমা গ্রামে মন্দিরটি রয়েছে সেখানেও লোকজনের আনাগোনা বেশ কম।
ইতিহাস বলছে, ছয় এবং আটের শতকে রাজপুতদের মধ্যে কিরাদ নামক গোষ্টিরা এই অঞ্চলে শাষণ করতো। সেই সময়ই বানানো হয়েছিল এই মন্দিরগুলি। কিরাডু মন্দিরের অন্তর্ভুক্ত বেশ কিছু মন্দির ভগবান শিবের, বাকিতে পুজো করা হত ভগবান বিষ্ণুর। কিরাদ রাজাদের শাষনকালে এই জয়গা সমগ্র রাজস্থানে বেশ জনপ্রিয় ছিল। এর প্রমাণ পুরানো ইতিহাস বইতেও পাওয়া যায়।
প্রাচীন জনশ্রুতি ও কিংবদন্তী বলছে, সমেশ্বর রাজার শাষণকালে এক সাধু তার ছাত্রদের নিয়ে এই মন্দিরে থাকতেন। শিক্ষার প্রসারের উদ্দেশ্যেই সেই সাধুবাবা এখানে এসেছিলেন। একদিন তিনি সিদ্ধান্ত নেন রাজস্থান ভ্রমণে বেরোবেন। সেই মতো তিনি বেরিয়েও পরেন। মন্দির দেখভালের দায়িত্ব এসে পরে ছাত্রদের উপর। ঠিক সে সময়ই এক মহামারীর আক্রমণে একের পর এক ছাত্রের মৃত্যু ঘটতে থাকে। এদিকে মৃত্যু ভয়ে কোনও গ্রামবাসীই এগিয়ে আসে না তাদের সাহায্য করতে। সে সময় কেবল একজন মহিলা দয়া পরবশ হয়ে বাচ্চাদের সেবা করা শুরু করেন। ধীরে ধীরে স্বাস্থ্যদ্ধার হতে শুরু করে ছাত্রদের। ততদিন কয়েক বছর কেটে গেছে। সবই ঠিক চলছিল। হঠাৎ একদিন সেই সাধুবাবা ফিরে আসেন। নিজের চোখকে তিনি বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। প্রিয় ছাত্রদের এই অবস্থা হয়েছে! রাগে-দুঃখে তিনি অভিশাপ দেন গ্রামবাসীদের। অভিশাপ ছিল, এই গ্রামে প্রাণের কোন অস্তিত্ব আর থাকবে না। সবাই পরিণত হবে পাথরে । কেবলমাত্র ওই মহিলা বেঁচে থাকবেন যিনি ছাত্রদের সাহায্য করেছিলেন। তিনি ঐ মহিলাকে গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে নির্দেশ দিয়ে বললেন, “ সাবধান এই মন্দির থেকে যাওয়ার সময় ভুলেও পিছনে ফিরে তাকাবে না, তাহলে তুমিও পাথর হয়ে যাবে।” সেই মহিলা সন্ন্যাসীর আজ্ঞা পালন করেন। কিন্তু জনপদের সীমান্তে পৌঁছে কৌতূহলবশত পিছনে ফিরে তাকান। দেখতে পান, গ্রামবাসীরা সকলেই পাথর হয়ে গিয়েছে। এই তাকনোর সঙ্গে সঙ্গে তিনিও পাথরে পরিণত হন। আজও মন্দিরের মাঝে সেই মহিলার পাথুরে মূর্তি নাকি দেখতে পাওয়া যায়।
আজ একবিংশ শতাব্দীতে এসেও পাথর হয়ে যাওয়ার ভয়ে স্থানীয় কাউকেই এ অঞ্চলে দেখতে পাওয়া যায় না। এমনকি পর্যটকদেরও এখানে আসতে মানা করা হয়েছে। তবু এক-দুজন অজান্তেই চলে আসেন এই পাথরের দুনিয়ায়।এই কাহিনির ঐতিহাসিক ও বৈজ্ঞানিক প্রমাণ আজও অস্পষ্ট হলেও, লোকবিশ্বাস এতটাই গভীরে যে তার শিকড় গেড়ে রয়েছে অনেক গভীরে, যার কারনে একে প্রায় ইতিহাসের মর্যাদা দেন স্থানীয় মানুষ। তাঁদের ধারণা, সূর্যাস্তের পরে আজও ক্রিয়াশীল হয়ে ওঠে সন্ন্যাসীর অভিশাপ। পাথরের মূর্তিরা ক্রমে প্রাণ ফিরে পায়, মরুভূমির শুকনো হাওয়ায় ভাসতে থাকে পাথরের দীর্ঘশ্বাস। প্রেতলোক আর ইহজগতের সীমানা আবছা হয়ে যায় কিরাডুতে। নেমে আসে ছায়ামূর্তির দল। তাই আজও সন্ধের পরে কিরাডুর অনুপম মন্দিরগুলি জনশূন্যই থাকে।
গল্প হলেও সত্যি, বেশ কিছুদিন আগে ইন্ডিয়ান প্যারানরমাল সোসাইটির বিশেষজ্ঞরা সমীক্ষা চালিয়েছিলেন কিরাডু মন্দির চত্ত্বরে। সেই সমীক্ষায় উঠে এসেছে যে এই অঞ্চলে প্রচুর নেগেটিভ এনার্জি রয়েছে, তা হতে পারে আত্মা বা অন্য কোন কিছু। এই অনুসন্ধানের পর থেকেই স্থানীয় প্রশাসন আরও কড়াকড়ি শুরু করেছে এই মন্দিরে আসা যাওয়ার ব্যাপারে।