শনিদেবের পাঁচালী এবং ব্রতকথা

প্রতি শনিবারে অন্তত একবার ভক্তিভরে শনিদেবের পাঁচালী ও ব্রতকথা শ্রবণ, পঠন ও কীর্ত্তন করুন। এতে কর্মফলদাতা শনিদেব আপনার প্রতি সন্তুষ্ট হবেন এবং জীবনের নানাবিধ বাধা-বিপত্তি দূর হবে। সেই সাথে শনিদেবের কৃপায় শনির সাড়ে সাতি থেকেও মুক্তি লাভ করতে পারবেন।

শনিদেবের ব্রতের নিয়ম

শনিবার সন্ধ্যাকালে ঘরের বাহিরে উঠানে এই ব্রত করতে হয়। শনিদেবের পূজাতে সত্যনারায়ণ পূজার মত সিন্নি দেওয়া হয়। সারাদিন উপবাসী থেকে সন্ধ্যায় শনিদেবের পূজার শেষে ব্রতকথা শ্রবণ করে নির্মাল্য প্রসাদ গ্রহণ করেবেন।

শনিদেবের ব্রতের উপকরণ

উৎকৃষ্ট ফল ৫টি, পান-সুপারী, কালোপাড় ধুতি, লোহার আসনাঙ্গুরীয়, মধুপর্কের বাটি, মাস কলাই, কালো তিল, নীল অপরাজিতা ফুল, নৈবেদ্য, মিষ্টান্ন, ধুপ-দ্বীপ, সিন্নির জন্য- আটা, দুগ্ধ, গুড়, কলা, বাতাসা, কালো মাটির ঘট বা লোহার ঘট, পুস্প, গঙ্গাজল ও গঙ্গামৃত্তিকা ইত্যাদি।

শনিদেবের পাঁচালী ব্রতের ফল

এই ব্রত পালন করলে শনিদেব সুপ্রশন্ন হন। সংসারে আপদ-বিপদ, দুঃখ কষ্ট দূর হয়ে সংসার শান্তিময় হয়। শনিদেবের কৃপায় সর্বপ্রকার গ্রহদোষ কেটে যায়।

শনিদেবের পূজাবিধি

আচমনাদি সমাপন করে, স্বস্তি বাচন ও সঙ্কল্প করে,  এবং গনেশাদি পঞ্চদেবতার পূজান্তে যথাবিধি ঘটস্থাপনাদি করে শনিদেবের ধ্যানান্তে যথাশক্তি উপচারে পূজা করবেন।

শনিদেবের ধ্যান

ওঁ সৌরাষ্ট্রং কাশ্যপং শূদ্রং সূর্য্যাস্যং চতুরঙ্গুলম।

কৃষ্ণং কৃষ্ণান্বরং গৃধ্রগতং সৌরিং চতুরর্ভুজম।

উদ্ববাণং শূলং ধনুর্হস্তং সমাহূয়েৎ।

যমাধিদৈবতং দেবং প্রজাপতি প্রত্যধিদৈবতম।

শনিদেবের পূজামন্ত্র

ওঁ ঐং হ্রীং শ্রীং শনৈশ্চরায়নমঃ।

শনিদেবের প্রণাম মন্ত্র

ওঁ নীলাঞ্জনচয়ং প্রখ্যং রবিসূতং মহাগ্রহম।

ছায়ায়া গর্ভসম্ভুতং বন্দে ভক্ত্যা শ্রীং শনৈশ্চরম।

অতঃপর নবগ্রহ, দশদিকপাল, ছায়া, সুবর্ণা, কালী, শিব, যম ও প্রজাপতির পূজা করার পরে শনিদেবের পঞ্চোপচারে পূজা করিবেন। শেষে- ‘ওঁ গৃধ্রায় নমঃ” মন্ত্রে গৃধ্রের পূজা করিবেন।

আরও পড়ুনঃ  শ্রী শ্রী সত্যনারায়ণের ব্রতকথা ও পাঁচালী

শনিদেবের পাঁচালী বা ব্রতকথা

শনিদেবের পাঁচালী ও ব্রতকথা
শনিদেবের পাঁচালী ও ব্রতকথা

শ্রীহরি নামেতে এক ছিল যে ব্রহ্মণ।

নিত্য ভিক্ষা করি করে উদর পূরণ।।

দিবা রাত্র কৃষ্ণ নাম জপে অকপটে।

অন্তরে সদাই সুখি অন্ন নাহি পেটে।।

হেনকালে তার একটি পুত্র জনমিল।

পুত্রের মুখ দেখি দ্বিজ বিষাদে ভাসিল।।

ভিক্ষা করি দ্বিজ সেবা পুত্র রক্ষা করে।

সুমঙ্গল বলি নাম রাখিল পুত্রেরে।।

অত্যন্ত মেধাবী পুত্র সবে গুন গায়।

অল্পদিন মধ্যে শিশু শিখে সমুদয়।।

শাস্ত্র আলোচনা করি শাস্ত্রজ্ঞ হইল।

পণ্ডিত বলিয়া তারে সকলে জানিল।।

মনে মনে সুমঙ্গল হরিকে ডাকিল।

গৃহ ছাড়ি নানা তীর্থে ঘুরিতে লাগিল।।

আচম্বিতে এক স্থানে করিল শ্রবণ।

পিতা মাতা পরলোকে করছে গমন।।

শুনি তাহা গয়াধামে করিয়া গমন।

বিষ্ণুপাদ পদ্মে শিশু করিল অর্পণ।।

কাল্বশে ঘটে যাহা কে করে খণ্ডন।

শনির দৃষ্টিতে পড়ে দ্বিজের নন্দন।

ভ্রমিতে ভ্রমিতে দ্বিজ যায় বহু দূরে।

শেষে উপস্থিত হয় বিদর্ভ নগরে।।

রাজার সভায় দ্বিজ উপস্থিত হৈল।

ব্রহ্মণ দেখিয়া রাজা অভ্যর্থনা কৈল।।

রাজার নিকটে দ্বিজ দেয় পরিচয়।

সুমঙ্গল নাম মোর ওহে মহাশয়।।

অতি দুঃখী হই আমি নাহি পিতা-মাতা।

নানা দেশে ভ্রমি আমি থাকি যথা তথা।।

শ্রীবৎস রাজন বলে, চিন্তা দূর কর।

আমার আশ্রয়ে থাকি মোরে কৃপা কর।।

শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত তুমি বুঝি অনুমানে।

শাস্ত্রপাঠে তুষ্ট কর সভাসদ্গণে।।

দুই পুত্র আছে মোর শুন হে ব্রহ্মণ।

পড়াইব তব কাছে করিয়াছি মন।।

রাজার বাক্যেতে দ্বিজ সন্তুষ্ট হইল।

রাজার আশ্রয়ে বাস করিতে লাগিল।।

দুই রাজপুত্রে দ্বীজ অতি যত্ন করে।

নিত্য পড়ায় দ্বিজ রাজার কুমারে।।

এই রূপে কিছুদিন বিগত হইল।

পড়ুয়া বেশেতে শনি উপস্থিত হইল।।

শনিরে জিজ্ঞেসে দ্বিজ, শুন বাছাধন।

কিবা হেতু হেতা তব হয় আগমণ।।

শনি বলে, এনু শাস্ত্র অধ্যায়ন তরে।

দ্বিজ বলে, যত্ন করে পড়াব তোমারে।।

অল্পদিন মধ্যে শনি সুপণ্ডিত হৈল।

সুমঙ্গল পরিচয় জানিতে চাহিল।।

আরও পড়ুনঃ  ভীষ্মপঞ্চক ব্রত কী, কখন ও কীভাবে করবেন?

শনি বলে, পরিচয় কিবা দিব আর।

শনৈশ্চর নাম মোর সূর্যের কুমার।।

সুমঙ্গল বল্লে যদি দেখা দিলে মোরে।

কিসে দুঃখ দূরে যাবে বল হে আমারে।।

আমার উপরে আছে তোমার কটাক্ষ।

কিসে যাবে বল প্রভু হইয়া স্বপক্ষ।।

শনি বলে, ভোগকাল ছয়মাস আছে।

দশদণ্ড মধ্যে যাবে না আসিবে কাছে।।

সপ্তম দিবসে গিয়া ভগীরথী তীরে।

একান্ত মনেতে দ্বিজ ভজ মুরারীরে।।

এত বলি শনিদেব অন্তর্ধান হৈল।

সুমঙ্গল আর তার দেখা না পাইল।।

শনি আজ্ঞামত দ্বিজ গিয়া গঙ্গাতীরে।

নারায়ণে ভজে দ্বিজ একান্ত অন্তরে।।

দশদণ্ড পূর্ণ হৈল মনেতে বিচারি।

উঠি দাঁড়াইল দ্বিজ বলিয়া শ্রীহরি।।

কিন্তু দশদণ্ড পূর্ণ না হয় তখন।

তার পূর্বে চলে আসে আপন ভবন।।

তাহা দেখি শনিদেব কূপিত হইল।

দুই রাজপুত্রে শনি হরণ করিল।।

পুনঃ মায়া বলে দুই শিশু মুণ্ড গড়ি।

দ্বিজের নিকটে শনি যান তাড়াতাড়ি।।

হেথা দ্বিজ চক্ষু বুজি শ্রীহরিরে স্নরে।

মুণ্ড দুটি ফেলে তার ঊরুর উপরে।।

হেথা নিদ্রা যোগে রাজা দুঃস্বপ্ন দেখিল।

পাত্র মিত্র লয়ে রাজা গঙ্গাতীরে গেল।।

দেখিয়া দ্বিজের কোলে পুত্র মুণ্ডদ্বয়।

হাহাকার করি রাজা ধূলায় লুটায়।।

রাজাদেশে দূতগণ বাঁধে ব্রহ্মাণেরে।

শৃঙ্খলে বন্ধন করি রাখে কারাগারে।।

কারাগারে বসে দ্বিজ কাঁদিতে লাগিল।

বিপদহন্তা মধুসূদনে স্মরিতে লাগিল।।

অতঃপর ঘটে এক বিচিত্র ঘটন।

দশদণ্ড বেলা পূর্ণ হইল যখন।।

শোকেতে কাতর রাজা ছিলেন যেখানে।

হেনকালে দুই পুত্র আসিল সেখানে।।

রাজা বলে, কোথা ছিলে হৃদয়ের ধন।

শয্যা পরে ছিনু পিতা করিয়া শয়ন।।

পুত্রদের বাক্যে রাজা আশ্চর্য হইল।

আদ্য অন্ত কিছু তার বুঝিতে নারিল।।

ব্রহ্মনের কথা এবে পড়ে গেল মনে।

না বুঝিয়া এত কষ্ট দিনু সে ব্রহ্মণের।।

রাজা দেশে দূত গিয়া আনিল বিপ্রেরে।

জীর্ণ শীর্ণ কলেবর কাঁদেন কাতরে।।

বিনয় বচনে রাজা করে তার স্ততি।

সব অপরাধ ক্ষমা কর মহামতি।

আরও পড়ুনঃ  ভগবান শ্রীশ্রীনৃসিংহদেবের আবির্ভাব ও চতুর্দশী ব্রত মাহাত্ম্য

কৃপা করি কর মোর সন্দেহ ভঞ্জন।

তব ক্রোড়ে কার মুণ্ড করেছি দর্শন।।

দ্বিজ বলে, মহারাজ কিছুই না জানি।

শনি কোপে কষ্টপাই এইমাত্র মানি।।

রাজা বলে, যদি পাই শনি-দরশন।

ষোড়শোপচারে তাঁর করিব পূজন।।

নৃপবাক্য শুনি দ্বিজ করিল গমণ।

শনির নিকটে সব করে নিবেদন।

শুনিয়া সকল কথা শনিদেব এল।

শনিদেবে দেখি রাজা প্রণাম করিল।।

রাজা বলে, যদি প্রভু এলে কৃপা করে।

পূজার বিধান তবে বল প্রভু মোরে।।

শনি বলে, পূজাবিধি শুন হে রাজন।

যে রূপে করিবে মোর পূজা আয়োজন।

শুদ্ধভাবে শুদ্ধমনে আমার বারেতে।

করিবে আমার পূজা একান্ত মনেতে।

নীলবস্ত্র কৃষ্ণতিল আর তৈল দিবে।

মাষকলাই আর মোষ সংগ্রহ করিবে।।

কৃষ্ণবর্ণ ঘট এক করিয়া স্থাপন।

পঞ্চজাতি ফল-ফুলে করিবে অর্চন।।

এই মোর পূজাবিধি কহিলাম সার।

ভক্তিই প্রধান জেনো কি কহিব আর।।

পূজা শেষে ভক্তিভরে করিবে প্রণাম।

নবগ্রহ স্তোত্র পাঠে লইবেক নাম।।

আমার প্রসাদ খাবে করিয়া যতন।

সর্বপাপ দূরে যাবে আমার বচন।।

অভক্তি করিয়া যেবা প্রসাদ খাইবে।

অল্পদিনে শমনের ভবনে সে যাবে।।

আমার পূজায় যেবা করে অনাদর।

চিরকাল দুঃখ পেয়ে হইবে কাতর।।

এই বলি শনি দেব হন অদর্শন।

ভক্তিভরে করে রাজা শনির পূজন।

প্রতি শনিবারে পূজা করে নৃপবর।

বিপ্রগণে দান দিয়া তুষিল বিস্তর।।

নৃপ-পাশে সুমঙ্গল বিদায় লইয়া।

শনিদেবে পূজা করে গঙ্গাতীরে গিয়া।।

এইরূপে পূজা প্রচারিল শনিদেবে।

যাঁহার যেমন সাধ্য সে ভাবে পূজিবে।।

শনির মাহাত্ম্য কে বর্ণিতে পারে।

কিঞ্চিত রচিত হৈল শনিদেবের বরে।।

সর্বদা শনির পদ থাকে যার মনে।

উদ্ধারে বিপদ হতে পরিলে শমনে।।

শনির পাঁচালী যেবা রাখিবে ভবনে।

কখনো না পরে সে বিপদ বন্ধনে।।

শনি প্রণমিয়া যেবা নিজ কার্য্যে যায়।

সমাদর করী তারে রাজার সভায়।।

স্কন্দ পূরেণের কথা অন্যথা না হয়।

যথাবিধি ব্যাসবাক্য কভু মিথ্যা নয়।।

শুদ্ধাশুদ্ধ জ্ঞানহীন বলে নিবারণ।

ভূমিতে লুটিয়া বন্দি শনির চরণ।।

এতদূরে এই গ্রন্থ সমাপন করি।

শনৈশ্চর প্রীতে সবে বল হরি হরি।

__অথ শনিদেবের ব্রতকথগা সমাপ্ত__

3.6/5 - (28 votes)

Leave a Comment

error: Content is protected !!