বৃটিশ ভারতে অন্ডাল-জেসিডি রুটের একটি ট্রেনে চড়েছিলেন এক ক্ষ্যাপাটে তান্ত্রিক। তাঁর পরনে ছিল শতছিন্ন-নোংরা পোশাক, ভাবসাবও ছিল একেবারে পাগলের মত। গোরা ইংরেজ টিসি সাহেব যখন তাঁর টিকিট চেক করতে আসলেন তখন যথারীতি তাঁর কাছে রেল ভ্রমণের কোন টিকিট পাওয়া গেল না। ফলত, ইকড়া স্টেশনের অদূরে ট্রেন থেকে নামিয়ে দেওয়া হল সেই পাগলাটে সাধুকে। সাধুটিও অত্যন্ত রুষ্ট হয়ে চলে গেলেন ইকড়া শ্মশানের দিকে। কিন্তু তাঁকে ট্রেন থেকে নামিয়ে দেওয়ার পর কোনভাবেই সেই ট্রেনকে আর চালু করা গেল না। ট্রেনে অবস্থানরত ইংরেজ চালক, গার্ড বা ইঞ্জিনিয়ার কেউই ইঞ্জিনের কোন ত্রুটি খুজে পেলেন না। অবশেষে স্টেশনের কুলিদের মাধ্যমে জানা গেল যাকে পাগল ভেবে এবং টিকিট না কাটার অপরাধে ট্রেন থেকে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে তিনি একজন সিদ্ধপুরুষ। ট্রেনের কর্মীরা তৎক্ষণাৎ ছুটলেন সেই সাধুবাবার খোঁজে। দেখা গেল নির্জন শ্মশানে মনের সুখে বসে আছেন সেই সাধুবাবা। ট্রেনের কর্মীরা তাঁকে বহু অনুনয় করলেও সাধুবাবা কিছুতেই আর ঐ ট্রেনে চড়তে রাজি হলেন না। তবে তিনি তাদেরকে আশ্বস্ত করে বললেন, ‘যাও তোমরা নিশ্চিন্তে যেতে পারো।’ এবং সাধুবাবার এই কথার পরে পুনরায় চালু হল ট্রেন।
আপনারা অনেকেই হয়ত ইতিমধ্যেই বুঝে গিয়েছেন, কে এই ক্ষ্যাপাটে সাধুবাবা। আজ্ঞে হ্যাঁ, তিনি এদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সিদ্ধপুরুষ তারা পুত্র বামাক্ষ্যাপা। আর আজ এই মহান সাধকের গল্প বলতে এসেছি আপনাদেরকে। আমাদের আজ জানতে পারবেন সাধক শ্রী শ্রী বামাক্ষ্যাপার সংক্ষিপ্ত জীবনী তথা তাঁর জন্ম, সিদ্ধিলাভ, মা তারা ও বামাক্ষ্যাপার মধ্যকার মা-ছেলের লীলা, এবং বাকসিদ্ধ বামাক্ষ্যাপার জীবনের কিছু রহস্যময় কাহিনী। সুতারাং বামদেব ও মা তারার কৃপা প্রাপ্ত করতে তারাপুত্রের এই জীবনীটি সম্পূর্ণ পড়ার অনুরোধ রইল। এবং সেইসাথে, কমেন্টে একবার জয় তারা লিখে যাওয়ার অনুরোধ রইল।
বামাক্ষ্যাপার জন্ম
বীরভূমের আটলা গ্রামে বাস করতেন সর্বানন্দ চট্টোপাধ্যায় ও রাজকুমারী দেবী নামের এক অত্যন্ত গরীব ব্রাহ্মণ দম্পতি। এক টুকরো জমিতে চাষাবাদ করে এবং ভজন কীর্ত্তন করে কোনমতে দুবেলা অন্নসংস্থান হত তাদের। এ দম্পতির প্রথম সন্তান ছিলেন জয়কালী দেবী। তো প্রথম সন্তান কন্যা হওয়ার কারনে একটি পুত্র সন্তানের জন্য মা তারার কাছে হত্যা দিয়েছিলেন এই দম্পতি। এর কিছুকাল পরে শিব চতুর্দশীর রাতের তৃতীয় প্রহরে রাজকুমারী দেবী একটি দেবতুল্য পুত্র সন্তান প্রসব করেন। পিতা সর্বানন্দ চট্টোপাধ্যায় বুঝতে পারলেন একদিকে শিব চতুর্দশীর তৃতীয় প্রহরে ভগবান শিবকে বামদেব নামে প্রণাম করা হয়, আবার অন্যদিকে, যে মা তারার কাছে হত্যা দিয়ে পুত্র সন্তান লাভ হয়েছে সেই তারা মায়ের আরেক নাম বামা। তিনি এই দুইয়ের সংযোগ বুঝতে পেরে পুত্রের নাম রাখলেন বামাচরণ চট্টপাধ্যায়। অর্থাৎ, তারা মায়ের চরণ। কিন্তু কে জানত, এই শিশুটি শুধু নামেই নয় একদিন সত্যিই তারা মায়ের সন্তান হিসেবে জগতে প্রসিদ্ধ হবে?
বামাক্ষ্যাপার ছোটবেলা
যাইহোক, জয়কালী দেবী ও বামাচরণ ছাড়াও দুর্গাদেবী, দ্রবময়ী ও সুন্দরী নামের তিন কন্যা ও রামচরণ নামের আরও একটি পুত্র সন্তান লাভ করেছিলেন সর্বানন্দ ও রাজকুমারী দম্পতি। সংসারের অবস্থা খারাপ হলেও পুত্র বামাচরণকে পাঠশালায় পাঠয়েছিলেন সর্বানন্দ মহাশয়। তবে প্রথাগত বিদ্যায় খুব বেশীদূর যেতে পারেননি বামাচরণ। কিছুকাল পরে পাঠশালার পাঠ ত্যাগ করে গ্রামে গ্রামে রামায়ণ-মহাভারত ও কীর্ত্তন গান গেয়ে দু পয়সা বাড়তি রোজগার করার চেষ্টা করতে থাকেন তিনি। তবে এর মাঝে মাঝে দ্বারকা নদী পাড়ি দিয়ে তিনি প্রায়শই চলে যেতেন তারাপীঠে। সেখানে কখনো তিনি শ্মশানে জ্বলন্ত চিতার কাছে বসে থাকতেন, কখনো বাতাসের সাথে কথা বলতেন, কখনো শ্মশানের আশেপাশে ধ্যানরত তান্ত্রিকদের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকতেন আর সর্বদাই মুখে বলতেন জয় তারা। তাঁর এসকল কর্মকাণ্ডের জেরে আশেপাশের লোকজন তাঁকে পাগল ভাবতে শুরু করল। আর তাঁর এই পাগলামির কারনে লোকমুখে বামাচরণের পরিবর্তে তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়ল বামাক্ষ্যাপা নামে।
বামাক্ষ্যাপার কর্মজীবন
মাত্র ১৮ বছর বয়সে পিতৃবিয়োগ ঘটে বামাক্ষ্যাপার। পরিবারের বড় পুত্র হওয়ার কারনে সংসারের দায়িত্ব এসে পড়ে তাঁর কাঁধে। অগত্যা মায়ের অনুরোধে মালুটি গ্রামের জমিদারবাড়ির কালী মন্দিরের ফুল তোলার কাজ নিলেন তিনি। কিন্তু কাজে কিছুতেই কাজে মন বসাতে পারেন না বামাচরণ। ফুল তুলতে গিয়ে জয় তারা বলে ফুলের বাগানে লুটিয়ে পড়ে থাকেন বামাচরণ, কখনো বা জয় তারা বলে ফুল ছুড়ে দেন শূন্যে। তাঁর এই পাগলামির কারনে তাঁকে ফুল তোলার কাজ থেকে ছাড়িয়ে নিয়োগ করা হল ঠাকুরের ভোগ রান্নার কাজে। কিন্তু সেখানেও তাঁর সেই একই দশা। ফলে তাঁকে ‘পাগল’ আখ্যা দিয়ে শেষ তাঁকে পর্যন্ত চাকরি থেকে বরখাস্ত করলেন জমিদারমশাই। পরবর্তীকালে এই মালুটিতেই মৌলিক্ষা মন্দিরে তিনি সিদ্ধিলাভ করেন এবং তারপরে তারাপীঠ মহাশ্মশানে সিদ্ধিলাভ করেছিলেন।
বামাক্ষ্যাপার সিদ্ধিলাভ
যাইহোক, এভাবে কিছুকাল অতিবাহিত হওয়ার পরে বামাক্ষ্যাপা সাক্ষাৎ পেয়েছিলেন ব্রজবাসী কৈলাসপতি নামের এক বাবার। তিনি তান্ত্রিক পিশাচসিদ্ধ। এই কৈলাসপতি বাবাই পরবর্তীতে তান্ত্রিক মতে দীক্ষাদান করেছিলেন বামাক্ষ্যাপাকে। দীক্ষাগ্রহণের পর গৃহত্যাগ করে চলতে লাগল বামাক্ষ্যাপার মাতৃ সাধনা। কখনো পঞ্চমুণ্ডির আসনে বসে, কখনো অনাহারে, আবার কখনো অঘোরিদের মত শব সাধনা করে সাধনা চালিয়ে গেলেন বামাক্ষ্যাপা। অবশেষে এল সেই মহেন্দ্রক্ষণ, ভাদ্র মাসের কৌশিকী অমাবস্যা তিথির রাত্রিতে যখন তিনি জ্বলন্ত চিতার পাশে শ্বেতশিমূল বৃক্ষের নীচে সাধনায় রত ছিলেন, তখন নীল আকাশ থেকে উজ্জ্বল আলোর বিচ্ছুরণ ঘটে ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে। সেই আলোকপুঞ্জ থেকে বেরিয়ে এলেন কোমরে বাঘের চামড়া পরিহিতা, এক হাতে অস্ত্র, এক হাতে মাথার খুলি, এক হাতে নীল পদ্ম, এবং এক হাতে খড়গ ধারণ করা এক দেবীমূর্তি। তিনি সস্নেহে মাথায় হাত রাখেন বামাক্ষ্যাপার। এরপর অভুক্ত বামাকে মাতৃস্নেহে দান করেন তাঁর নিজের স্তন্যসুধা।
এই অলৌকিক-অত্যাশ্চর্য ঘটনায় চৈতন্য হারিয়ে সমাধিমগ্ন হয়ে পড়েন বামাক্ষ্যাপা। এরকম সমাধিমগ্ন অবস্থায় তিনি ৩ দিন ও ৩ রাত সেখানেই অবস্থান করেন। কিন্তু ৩ দিন পর প্রকৃতিস্থ হয়েই চিৎকার করে এদিক ওদিক দৌড়াতে থাকেন বামা। গ্রামবাসীরা নিশ্চিত হলেন, বামা এতদিন অর্ধ পাগল ছিলেন আজ তিনি সম্পূর্ণ পাগল হয়ে গেছেন। প্রায় একমাস যাবত চলল বামার এই পাগলামী।
তারাপীঠের পুজারী বামাক্ষ্যাপা
যাইহোক, সেসময়ে তারাপীঠের পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিল নাটোরের রাজপরিবার। একদিন, ভগবতী তারা নাটোরের রাণীকে স্বপ্নাদেশ দিয়েছিলেন বামাকে তারাপীঠ মন্দিরের পুরোহিত নিযুক্ত করার জন্য। রানীমা মা তারার এই আদেশ শিরোধার্য করে বামাকে মন্দিরের পুরোহিত নিযুক্ত করেন। কিন্তু ক্ষ্যাপাটে বামাকে পুরোহিত নিযুক্ত করার এই ব্যাপারটা ভালোভাবে মানতে পারেননি তৎকালীন ব্রাহ্মণ পুজারী ও পাণ্ডারা। অন্যদিকে বামাচরণের পূজা করার পদ্ধতিও ছিল অস্বাভাবিক রকমের অদ্ভূত। পূজা অর্চনার কোন নিয়ম কানুনের কোন রকম তোয়াক্কা করতেন না তিনি। তিনি না মানতেন কোন নিয়ম কানুন না মানতেন কোন মন্ত্র তন্ত্র। কখনো দেখা যেত তিনি মাকে ভক্তি করছেন আবার কখনোবা মা তারাকে গালি দিচ্ছেন। পূজার সময় সংস্কৃত মন্ত্রের বদলে নিজের ইচ্ছামত বাংলায় মন্ত্র বলতেন তিনি। চন্দনের বদলে নিজের চোখের জলে ফুল মাখিয়ে নিতেন বামাক্ষ্যাপা। তারপর তা ছুঁড়ে দিতেন মায়ের বিগ্রহের দিকে। কিন্তু কি আশ্চর্য ! ফুলগুলো ঠিক মালার আকারে সজ্জিত হতো দেবীর কন্ঠে। সাধনমগ্ন বামা সারাদিন থাকতেন ভাবসমাধিতে বা ঘোরের মধ্যে। একদিন বামদেব মায়ের বিগ্রহে মূত্রই ত্যাগ করে দিলেন। এ নিয়ে হৈ চৈ পড়ে গেলে বামদেব বললেন- আমি আমার মার কোলে যা ইচ্ছা তাই করব তাতে কার কি? মা তারাকে তিনি এতটাই ভালোবাসতেন যে, তিনি তাঁকে সম্বোধন করতেন বড় মা, আর তাঁর নিজের মাকে বলতেন ছোট মা। আর সঙ্গত কারনেই তিনি যখন তারা মায়ের পূজা করতেন তখন চারধারে ভিড় জমত দর্শকদের। সবাই দেখত ক্ষ্যাপাটে পুজারী বামুনের খেয়ালীপনা।
বামাক্ষ্যাপা প্রায়শই তারা মায়ের উদ্দেশ্যে নিবেদন করা প্রসাদ ও নৈবেদ্য আগেই খেয়ে ফেলতেন এবং তাঁর উচ্ছিষ্ট খাবার অর্পণ করতেন মা তারাকে। এ ব্যাপারে তাঁর মত ছিল, সন্তানকে অভুক্ত রেখে কোন মাই খেতে পারেন না। তাছাড়া, মায়ের উদ্দেশ্যে নিবেদন করা প্রসাদ মায়ের উপযুক্ত কিনা সেটাও পরীক্ষা করে দেখতেন তিনি। এ যেন সেই রামায়ণের শবরী মাতার ঘটনার পুনরাবৃত্তি।
তো একদা তারা মায়ের প্রসাদ খাওয়াকে কেন্দ্র করে তাঁকে বেদম প্রহার করে মন্দির থেকে বের করে দেন ব্রাহ্মণেরা। কিন্তু সেই রাতেই নাটোরের রাণীমা মা তারার স্বপ্নাদেশ পান। স্বপ্নে মা তারা রানীমাকে বলেছিলেন, আমার পুত্র বামাকে অভুক্ত রেখে প্রহার করার কারনে আমি নিজেও অভুক্ত ও রক্তাক্ত। রাণীমা অতিদ্রুত এ ঘটনা সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে আবারও বামাকে নিযুক্ত করেছিলেন মন্দিরের পূজারী হিসেবে। আর সেখান থেকেই মা তারার উদ্দেশ্যে ভোগ নিবেদন করার আগে বামাক্ষ্যাপাকে ভোগ নিবেদন করা হত।
বামাক্ষ্যাপার মাতৃবিয়োগ
বামদেবের গর্ভধারিণী মা যখন দেহরক্ষা করলেন, তখন বর্ষাকাল। তাঁর পারলৌকিক ক্রিয়ার ঠিক দুদিন আগে ভাই রামচরণ এলো দাদার সাথে মায়ের ক্রিয়াকর্মের বিষয়ে আলোচনা করতে। আপনভোলা বামা বলে বসলেন- “দু-চারখানা গ্রামের মানুষকে নেমন্তন্ন করে তৃপ্তি সহকারে খাওয়াবি কিন্তু!” ভাই রামচরণ তো থতমত খেল। নিজেদের জন্য দুমুঠো অন্নদানা জোগাড় করতেই সূর্যাস্ত হয়ে যায়, আর দু-চারখানা গ্রামের মানুষকে খাওয়ানো কি মুখের কথা! যাইহোক, দাদার আদেশ মাথায় নিয়ে রামচরণ ফিরলেন বাড়িতে। কিন্তু শ্রাদ্ধের দিন ঘটলো এক বিস্ময়কর কাণ্ড! সকাল না হতেই দেখা গেল ভিন গ্রাম থেকে দলে দলে মানুষ চালের ধামা, ফলের ঝুড়ি, মিষ্টির হাড়ি, বা শাকসবজি নিয়ে হাজির শ্রাদ্ধবাড়িতে। রামচরণ বুঝলেন, এসব তার দাদারই সিদ্ধশক্তির নিদর্শন। যাইহোক, বেলা বাড়ার সাথে সাথে কালো মেঘে ঢেকে গেল আকাশ, এবার বুঝি শ্রাদ্ধ বা ভোজনের সব আয়োজন পণ্ড হয়। ভাই রামচরণ মুখ ভার করে এলেন দাদার কাছে। আত্মস্থ বামা একটি কাঠি দিয়ে বাড়ির চারিধারে গণ্ডি কেটে দিলেন আর আত্মমগ্ন হয়ে বললেন- “বৃষ্টি হবে। কিন্তু এই গণ্ডির ভেতর ঢুকতে পারবে না। নিশ্চিন্তে থাক।” হলও তাই। মুষলধারে বর্ষণ হতে লাগলো, কিন্তু বামদেবের গণ্ডির ভেতরের ভূমি শুকনো। কোনমতেই সেই দাগকে অতিক্রম করে জল প্রবেশ করতে পারল না ভেতরে। যত জোরে মেঘের গর্জন হয়, তত জোরে বামার কণ্ঠে শোনা যায় “জয় তারা, জয় জয় তারা” ভীমধ্বনি। উপস্থিত আমন্ত্রিতরা খাওয়া ভুলে ভয়ার্ত চোখে দেখতে লাগলেন এই অলৌকিক দৃশ্য।
নগেণ পাণ্ডা ও বামাক্ষ্যাপা
একদা তারাপীঠের নগেন পাণ্ডা এসে ধরলেন ক্ষ্যাপা বাবাকে। তাঁর পরিচিত এক জমিদার মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, কোন ডাক্তার-কবিরাজই জমিদারের অবস্থার কোন উন্নতি করতে পারেননি। নগেন জানতেন বামদেব বাকসিদ্ধ। তিনি যদি একবার মুখ ফুটে জমিদার বাবুর সুস্থ হওয়ার কথা বলেন তাহলে তারা মায়ের কৃপায় জমিদার বাবু সুস্থ হতে বাধ্য।
যাইহোক, নগেনের চাপাচাপিতে জমিদার বাড়িতে যেতে রাজি হলেন বামাক্ষ্যাপা। পালকি চড়ে যাওয়ার সময় নগেন ক্ষ্যাপাবাবাকে বোঝাতে লাগলেন, ‘বাবা, আপনাকে বিশেষ কিছু করতে হবে না – শুধু রোগীর কাছে গিয়ে জোর গলায় বলবেন, এই উঠে বোস্, তোর রোগ ভাল হয়ে গেছে। আপনি মুখ দিয়ে ওইটুকু বললেই কেল্লা ফতে।’ বামাক্ষেপা সরল শিশুর মতোই বললেন, ‘তুমি যখন বলছ, তখন তা-ই বলব। যদি ভুলে যাই, তুমি আমাকে একটু মনে করিয়ে দিও নগেন খুড়ো।’
কিন্তু রোগীর ঘরে ঢুকেই ক্ষ্যাপাবাবা যা বললেন তাতে সকলের আক্কেল গুড়ুম। রোগীকে দেখামাত্র তিনি বলে উঠলেন, ‘ও নগেন খুড়ো, এ শাল তো এখনি ফট।’ একথা বলেই বামাক্ষ্যাপা বাইরে এসে পালকিতে চড়ে বসলেন। ওদিকে জমিদারবাবুও বামাক্ষ্যাপার প্রস্থানমাত্র শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। এতে নগেন পাণ্ডা বাইরে এসে রাগতস্বরে ক্ষ্যাপাবাবাকে বললেন, ‘এ আপনি কি করলেন। এরকম করবেন জানলে, আমি আপনাকে এখানে নিয়েই আসতাম না।’ সরল বালকের মতোই ক্ষ্যাপা উত্তর দিলেন, ‘আমি তো তোমার শেখানো কথাই বলতে গিয়েছিলাম, কিন্তু মা তারা যে বাধা দিলেন, বললেন, ওকথা বলিস না, বলে দে ফট। তাই আমি তাই বললাম।
দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও বামাক্ষ্যাপা
একদা বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এলেন ক্ষ্যাপাবাবার সাথে সাক্ষাৎ করতে। তিনি নিজে ব্রাহ্ম ধর্মের অনুসারী হলেও বামাক্ষ্যাপার প্রতি তাঁর ছিল অগাধ শ্রদ্ধা। ফেরার সময় বামাক্ষ্যাপা মহর্ষিকে বললেন,“ফেরার পথে ট্রেন থেকেই দেখতে পাবে একটা বিশাল মাঠ। সেই মাঠের মাঝখানে আছে একটা ছাতিম গাছ আছে। তার নীচে বসে ধ্যান করবে। দেখবে মনের ভিতরে আনন্দের জ্যোতি জ্বলে উঠছে। ওখানে একটা আশ্রম বানাও দেখি। আহা, শান্তি শান্তি!” ফেরার পথে সেই মাঠ এবং ছাতিম গাছ দেখে চমৎকৃৎ হলেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। বামাক্ষ্যাপার কথামত সেখানে বসে কিছুক্ষণের জন্য ধ্যানে মগ্নও হলেন তিনি। কথিত আছে পরবর্তীকালে এই স্থানেই প্রতিষ্ঠিত হয় শান্তিনিকেতন।
স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় ও বামাক্ষ্যাপা
বাংলার বাঘ স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় ১৯০১ খ্রিষ্টাব্দে তার মা এবং স্ত্রীকে নিয়ে তারাপীঠে বামাক্ষ্যাপাকে দর্শন করার জন্য গিয়েছিলেন। আশুতোষ বামাক্ষ্যাপাকে ভক্তিভরে প্রণাম করতেই তিনি বলে উঠেছিলেন,“যা যা, তোর মনের ইচ্ছা পূর্ণ হবে। তুই শালা জজ হবি। ” আশুতোষ তখন হাইকোর্টের আইনজীবী। কিন্তু মনে মনে জজ হওয়ার খুব ইচ্ছে ছিল তার। কিন্তু একথা বামাক্ষ্যাপা জানলেন কিভাবে? আর কি আশ্চর্য! ১৯০৪ সালে হাইকোর্টের জজ হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়।
বীন্দ্রনাথ ঠাকুর, চারণকবি মুকুন্দদাস ও বামাক্ষ্যাপা
একবার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও চারণকবি মুকুন্দদাস তারাপীঠে গিয়ে বামাক্ষ্যাপার সাক্ষাৎপ্রার্থী হন। সারাদিন অপেক্ষার পর সন্ধ্যায় দর্শন পেলেন বামাক্ষ্যাপার। তাদের দুজনকে তারা মায়ের প্রসাদ খেতে দিয়ে ক্ষ্যাপাবাবা মুকন্দদাসকে বললেন, “তোর ফুটুস কলটা নদীতে ফেলে দিয়ে আয়।” আসলে মুকুন্দদাসের কোমরে একটা রিভলভার গোঁজা ছিল। কিন্তু বামাক্ষ্যাপা তা কিভাবে জানলেন?
সেদিনকার সাক্ষাৎ এ তিনি রবীন্দ্রনাথকে বলেছিলেন, ‘তোর খুব নামডাক হবে।’ আর সেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরই সমগ্র এশিয়ার মধ্যে সর্বপ্রথম নোবেল পুরষ্কার এনে দিয়েছিলেন ভারত মাতাকে।
স্বামী বিবেকানন্দ ও বামাক্ষ্যাপা
একদা ১৯ বছর বয়সী নরেন নামের এক যুবক তাঁর কলেজের সহপাঠী শরৎচন্দ্রকে নিয়ে ক্ষ্যাপাবাবার দর্শনে গিয়েছিলেন। কিন্তু নরেনকে দর্শনমাত্র নরেন ও ক্ষ্যাপাবাবা দুজনের চোখই ভিজে উঠল অশ্রুতে। ক্ষ্যাপাবাবাকে দর্শন করেই এক অলৌকিক আনন্দ প্রাপ্ত হলেন নরেন্দ্রনাথ। পরবর্তীতে শরৎচন্দ্রকে ক্ষ্যাপাবাবা বলেছিলেন, “এই যুবক একদিন ধর্মের মুখ উজ্জ্বল করবে।” বাকসিদ্ধ বামাক্ষ্যাপার কথা বিফলে যায় নি মোটেই। পরবর্তীতে এই নরেনই একদিন বিশ্বের দরবারে তুলে ধরেছিলেন সনাতন ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব। আর তিনি নিজে পরিচিত হয়েছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ নামে।
বামাক্ষ্যাপার কৃপা
যাইহোক, ক্ষ্যাপাবাবার অসংখ্য লীলা বর্ণনা করা এরকম লেখা দ্বারা সম্ভব নয়। তিনি কখনো বালকবত হয়ে মা তারার কাছে এসে আবদার বায়না করতেন, কখনো উন্মাদের মত শ্মশানে বিচরণ করে অট্টহাস্য করতেন, কখনো ক্রোধে এমন ‘জয় তারা’ রব তুলতেন যে গোটা শ্মশানভূমি কেঁপে উঠতো। তাঁর কৃপা পেয়ে বহু মুমূর্ষু রোগী হয়ে উঠেছিলেন একেবারে সুস্থ। তবে তিনি কিন্তু কোন তাবিজ-কবজ বা জলপোড়া-তেলপোড়া দিতেন না। কাউকে রেগে পদাঘাত করে বা কারো উপরে থুথু ছিটিয়ে দিতেই সেই রোগী একেবারে ফিরে আসত যমের দুয়ার থেকে। আবার কখনোবা বিরক্ত হয়ে কাউকে মায়ের প্রসাদী ফুল বা শ্মশানের মাটি তুলে ছুড়ে মারতেন, তাতেই সমস্যা মিটে যেতো দুর্দশাগ্রস্থ মানুষের।
বামাক্ষ্যাপার তিরোধান
তারা মায়ের এই পাগল ছেলে তাঁর ভবলীলা সাঙ্গ করেছিলেন ১৯১১ সালে। তাঁর সাধন স্থল তারপীঠেই সমাধিস্থ করা হয় তাঁকে। এ তারাপীঠের পবিত্র মাটিতে মিশে গিয়ে যেন মা-ছেলের পুনর্মিলন ঘটল তারাপীঠে।