ঈশ্বরকে যে কোনও কোনও ভাগ্যবানেই কেবল ‘দেখিবারে পায়’, সে কথা ভক্তমাত্রেই জানেন। কিন্তু যদি আপনাকে বলা হয় যে, ভগবানের মন্দিরও মধ্যে মধ্যে অদৃশ্য হয়ে যেতে পারে, তবে কী হবে আপনার প্রতিক্রিয়া ? আজ্ঞে হ্যাঁ, সেরকম মন্দিরও রয়েছে, আর সেটাও এই ভারতের মাটিতেই। এবং স্বাভাবিকভাবে তা দেবাদিদেব মহাদেবেরই মন্দির। আপনারা জানেন, আত্মভোলা শিবের বরাবরই পছন্দ গহীন অরণ্য, নির্জন শ্মশান, সুউচ্চ পর্বত শৃঙ্গ অথবা গভীর সমুদ্র গর্ভ। তারই ধারাবাহিকতায় আপনাদেরকে পরিচয় করিয়ে দিতে চাই, এমন এক মন্দিরের সাথে যা সমুদ্র গর্ভ থেকে দিনে মাত্র দুই বার ভেসে ওঠে। অলৌকিক এই মন্দিরের দৈবিক প্রভাব চলে আসছে যুগ যুগ ধরে যা বিষ্ময়ের সমস্ত সীমানা অতিক্রম করেছে ভক্ত ও পর্যটকবৃন্দের। মনে প্রশ্ন জেগেছে ‘কে নির্মান করেছিলেন এই মন্দির? কেনই বা দিনে দুইবার অদৃশ্য হয়ে যায় এই মন্দির? দর্শক, আমরাও স্বচক্ষে দেখতে চাই এই স্বর্গীয় মন্দিরের রহস্যজাল। কথা না বাড়িয়ে চলুন ঘুরে আসি এই ডিসাপিয়ারিং টেম্পল থেকে।
গুজরাটের ভাদোদরা থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে ছোট্ট শহর কাভি কাম্বোই। এই শহরের পাশ দিয়ে বহমান আরব সাগর ও ক্যাম্বি উপসাগরের মাঝামাঝি উপকুলীয় তটরেখায় অবস্থিত মহাদেবের রহস্যময় এই মন্দির। এর নাম শ্রী স্তম্ভেশ্বর মহাদেব মন্দির। মন্দিরের নামের মাহাত্ম্য জানা না গেলেও এর অলৌকিকত্বের জন্য ইতিমধ্যে সারা বিশ্বের মনোযোগ আকর্ষন করেছে এই মন্দির। প্রতিদিন সকাল ও সন্ধ্যায় মন্দিরটি শিবলিঙ্গসহ সমুদ্রগর্ভে বিলীন হয়ে যায় আবার কিছুক্ষন পরেই আবারো দৃশ্যমান হয় সমুদ্রের জলস্তর নিচে নামলে। স্রস্টার এমন অপরুপ লীলা দেখার জন্য শুধু ভারতবর্ষই নয়, সমগ্র বিশ্ব থেকে কৌতুহলী মানুষ ছুটে আসেন তাদের কৌতুহল মেটানোর জন্য। সমুদ্রের জলে মন্দিরের সম্পূর্ণ নিমজ্জন এবং তারপর আস্তে আস্তে তার জলমুক্তির দৃশ্য— স্বভাবতই এক অলৌকিক অভিজ্ঞতা পর্যটকদের কাছে। দূর দূরান্ত থেকে পর্যটক ও ভক্তরা এই দৃশ্য দেখার জন্য উপস্থিত হন মন্দিরে। এই মন্দিরের রীতি হল, ভক্তরা সকাল সকাল চলে যান মন্দিরে, পূজার্চনা সেরে নেন। তারপর শুরু হয় তাঁদের অপেক্ষা। সেই সময়টা কেউ কেউ সমুদ্রের শোভা উপভোগ করেন, কেউ বা মন্দিরে বসেই ঈশ্বরচিন্তায় নিমগ্ন হন। তারপর জোয়ারের সময় এগিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে ফাঁকা হয়ে আসতে থাকে মন্দির চত্বর। ভক্ত ও দর্শনার্থীরা নিরাপদ দূরত্বে সরে যান। তাঁদের চোখের সামনে শুরু হয়ে যায় আশ্চর্য প্রাকৃতিক লীলা। জোয়ারের জল বাড়তে বাড়তে গ্রাস করে ফেলে পুরো মন্দিরটাকেই। তখন সেদিকে তাকালে মন্দিরের অস্তিত্ব পর্যন্ত চোখে পড়ে না। কিছুক্ষণ কাটে এইভাবে। তারপর আবার সরে যেতে থাকে জোয়ারের জল। জলের উপরে প্রথমে দৃশ্যমান হয় মন্দিরের চূড়া। তারপর আস্তে আস্তে গোটা মন্দিরটাই জেগে ওঠে জল থেকে। সাময়িকভাবে মন্দিরটি মানবদৃষ্টির সম্পূর্ণ আড়ালে চলে যায় বলেই একে অনেকে ‘অদৃশ্য মন্দির’ বলে থাকেন।
প্রশ্ন হল কে নির্মান করেছিলেন এই মন্দির? আর কিভাবেই অথৈ সমুদ্রের মাঝে এমন মন্দির নির্মান করা সম্ভব হল? হিন্দু পুরান বলছে এই মন্দিরটির নামের সাথে জড়িয়ে রয়েছেন স্বয়ং ভগবান শিব, তার পুত্র, দেবসেনাপতি কুমার কার্তিকেয় ও তারকাসুর নামের ভয়ানক এক অসুর। কোন এক সময় তারকাসুর নামের এক মহাপরাক্রমশালী অসুর মহাদেবের কাছ থেকে বর লাভ করেন যে একমাত্র মহাদেবের পুত্র ব্যাতিরেক তাকে কেউ হত্যা করতে পারবে না। যা এক কথায় প্রায় অমরত্বের শামিল। কারন মহাদেব শ্মশানচারী এবং সন্যাসী। সুতারাং তার পক্ষে গৃহী বা পিতা কোনটিই হওয়া সম্ভব নয়। বর পেয়ে তারকাসুর স্বর্গ মর্ত্য পাতালে তুমুল তাণ্ডবলীলা শুরু করলেন। সমগ্র সৃষ্টি ত্রাহি ত্রাহি রব তুলে কাঁপছে তার অত্যাচারে। এভাবেই সৃষ্টিতে যখন মহাপ্রলয় ঘটার যোগাড়, তখনই কুমার কার্তিকেয় জন্ম নিলেন মহাদেব শিব ও মাতা পার্বতীর ঘরে। এর পর বরদান অনুযায়ী তিনি হত্যা করলেন মহাপরাক্রমশালী তারকাশুরকে। শান্তি ফিরে এল পৃথিবীতে। কিন্তু তারকাসুরের মৃত্যুর পর যখন কুমার কার্তিকেয় জানতে পারলেন যে এই অসুর স্বয়ং তার পিতা শিবের ভক্ত ছিলেন, তখন তিনি প্রচন্ড ভেঙ্গে পড়লেন। চরমতম পাপবোদ্গ গ্রাস করল কুমার কার্তিকেয়কে। এমতাবস্থায় এগিয়ে এলেন শঙ্খ চক্র গদা পদ্ম ধারী শ্রী নারায়ন। তিনি কার্তিকেয়কে বোঝালেন পাপীকে বিনাশ করার মধ্যে কোন পাপ বোধ নেই। কিন্তু তবুও পাপবোধ নিবৃত্ত হচ্ছিল না কার্তিকের। তখন শ্রী হরি তাকে মহাদেবের আরাধনা করে পাপ্সখলনের পরামর্শ দিলেন। তার পরামর্শে কুমার কার্তিকেয় আরব সাগরের যের স্থানে বসে মহাদেবের আরাধনা করেছিলেন, সেখানেই পরবর্তীকালে নির্মিত হয় স্তম্ভেশ্বর মহাদেব মন্দির। বর্তমান মন্দিরটি প্রায় ১৫০ বছরের পুরোনো। তবে এর আগে এখানে কোন মন্দির ছিল কিনা, বর্তমান মন্দিরটি কে এবং কিভাবে নির্মান করেছিলেন তা আর জানা যায় না।
ভক্তেরা গোটা বিষয়টিকেই ঐশ্বরিক লীলা হিসেবে ব্যাখ্যা করেন। তাঁদের ধারণা, স্বয়ং মা গঙ্গা এইভাবেই প্রকৃতির মাধ্যমে মহাদেবের জল-অভিষেক ঘটিয়ে থাকেন। তবে বিজ্ঞানীদের মতে, বিষয়টি সাধারণ প্রাকৃতিক নিয়ম মাত্র। তবে ঘটনার নেপথ্য কারণ যা-ই হোক, প্রতিদিন এইভাবে সমুদ্রজলে নিমজ্জিত হওয়ার পরেও মন্দির ও তাঁর অভ্যন্তরস্থ শিবলিঙ্গটি সম্পূর্ণ অক্ষত রয়ে গিয়েছে, এটাও যে কম বিস্ময়কর ঘটনা নয়, তা মানছেন বিজ্ঞানীরাও।