সৃষ্টির মূল কারণ ঈশ্বর নাকি প্রকৃতি
সৃষ্টির কারণ সম্বন্ধে দু’রকমের মতবাদ রয়েছে। একটি মত হচ্ছে যে, সৎ, চিৎ ও আনন্দময় পরমেশ্বর ভগবান থেকে এ জড়জগৎ গৌণভাবে সৃষ্ট এবং মুখ্যভাবে চিৎজগতের প্রকাশ, যা অনন্ত বৈকুন্ঠলোক এবং তাঁর স্বীয় ধাম গোলক বৃন্দাবন। পক্ষান্তরে, ভগবানের সৃষ্টির দুটি প্রকাশ- জড়-জগৎ ও নক্ষত্র ও ব্রহ্মান্ড রয়েছে, চিৎ-জগতেও তেমন গোলক, বৈকুণ্ঠ আদি অসংখ্য চিন্ময় লোক রয়েছে। পরমেশ্বর ভগবান জড়-জগৎ ও চিৎ-জগৎ উভয়েরই কারণ। অপর মতবাদটি হচ্ছে যে, এক অব্যক্ত অপ্রকাশ শূন্য থেকে সবকিছু সৃষ্টি হয়েছে। এই মতবাদটি সম্পূর্ণ অর্থহীন।
প্রথম মতটি বেদান্ত দার্শনিকেরা স্বীকার করেন এবং দ্বিতীয় মতটি বেদান্ত সিদ্ধান্তের বিরোধী সাংব্যস্মৃতি নামক নাস্তিক মতবাদ। জড় বৈজ্ঞানিকেরা কোনো চিন্ময় বস্তুকে সৃষ্টির কারণরূপে দর্শন করতে পারেন না। এধরনের নাস্তিক সাংখ্য দার্শনিকেরা মনে করেন যে, অসংখ্য প্রাণীর মধ্যে যে জীবনীশক্তি ও চেতনার লক্ষণ দেখা যায়, তা প্রকৃতির তিনটি গুণ থেকে উৎপন্ন। এভাবেই সাংখ্য মতাবলম্বীরা সৃষ্টির কারণ সম্বন্ধে বেদান্ত সিদ্ধান্তের বিরোধী।
বাস্তবিকপক্ষে, পরম পূর্ণ আত্মাই সমস্ত সৃষ্টির কারণ এবং তিনি শক্তি ও শক্তিমান উভয়রূপে সর্বদাই পূর্ণ। সমস্ত শক্তি যাঁর মধ্যে নিহিত রয়েছে, সেই পরম পুরুষের শক্তি থেকেই জড়জগতের সৃষ্টি। যেসমস্ত দার্শনিক বিশ্বসৃষ্টির কারণ সম্বন্ধে জল্পনা-কল্পনার দ্বারা এক-একটি মতবাদ সৃষ্টি করেন, তাঁরা কেবল জড় শক্তির চমৎকারিত্বই উপলব্ধি করেন।
একধরনের দার্শনিকেরা ভ্রান্তিবশত মনে করেন যে, এ জগতের সমস্ত জীব জড়শক্তি থেকে উদ্ভূত। এতএব, পরম চৈতন্যময় পুরুষও নিশ্চয়ই জড় শক্তিসম্ভূত। জড় দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিকেরা যেহেতু তাঁদের ভ্রান্ত ইন্দ্রিয়গুলো নিয়ে অত্যন্ত ব্যস্ত, তাই তাঁরা স্বাভাবিকভাবেই সিদ্ধান্ত করেন, জীবনীশক্তিও নিশ্চয়ই জড় পদার্থের সমস্বয়ের ফলে উদ্ভূত।
কিন্তু প্রকৃত তত্ত্বটি তার ঠিক বিপরীত- জড় পদার্থ চেতনাশক্তি থেকে উদ্ভূত। ভগবদ্গীতায় বলা হয়েছে যে, পরম আত্মা পরমেশ্বর ভগবান হচ্ছেন সমস্ত শক্তির উৎস। কেউ যখন দেশ ও কালের দ্বারা সীমিত বিষয়বস্তু অধ্যয়ন করে গবেষণা করে, তখন তিনি প্রকৃতির বৈচিত্র্য দর্শন করে বিস্ময়ান্বিত হন এবং স্বাভাবিকভাবেই স্বপ্নাবিষ্টের মতো আরোহ পন্থার গবেষণা করতে তৎপর হন। সেই পন্থার ঠিক বিপরীত হচ্ছে আবরোহ পন্থা।
এই আবরোহ পন্থায় পরম পুরুষ ভগবানকে সর্ব কারণের পরম কারণরূপে জানা যায়; তাঁর মধ্যে অনন্ত শক্তি বর্তমান এবং তিনি নিরাকার নন, শূন্যও নন। তাঁর নির্বিশেষ প্রকাশ তাঁরই একটি শক্তির প্রকাশ। এতএব, জড়পদার্থ থেকে জড়জগৎ সৃষ্টি হয়েছে বলে যে মতবাদ, তা প্রকৃত সত্যের সম্পূর্ণ বিপরীত মতবাদ। অনন্ত শক্তিমান পরমেশ্বর ভগবানের দৃষ্টিপাত হচ্ছে জড় সৃষ্টির মূল কারণ।
প্রকৃতি সর্বশক্তিমান থেকে প্রাপ্ত শক্তি লাভ করে জীবের জড় ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য দেশ-কালের অন্তর্গত জড়জগৎ নির্মাণ করেন। পক্ষান্তরে, পরমেশ্বর ভগবান তাঁর জড় শক্তির প্রকাশের দ্বারাই জড় দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিক আদি বদ্ধজীবদের কাছে উপলব্ধ হন। শক্তির সঙ্গে শক্তিমানের সম্পর্ক হৃদয়ঙ্গম করতে না পারার ফলে, যিনি পরমেশ্বর ভগবানের ক্ষমতা এবং তাঁর বিভিন্ন শক্তি সম্বন্ধে অবগত নন, তাঁর বিচারে সর্বদাই ভ্রান্তির সম্ভাবনা থাকে এবং তাকে বলা হয় বিবর্ত। যতক্ষণ পর্যন্ত জড় দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিকেরা প্রকৃত সিদ্ধান্তে উপনীত না হচ্ছেন, ততক্ষণ তাঁরা অবশ্যই পরমতত্ত্ব সম্বন্ধে অজ্ঞতাবশত জড়জগতে ইতস্তত বিচরণ করতে থাকবেন।
নিরীশ্বর কপিলের মতে, জড়াপ্রকৃতি নিত্য এবং সর্ব শক্তিশালী। চেতন বলতে কিছু নেই এবং জড়ের কোনো কারণ নেই। জড় পদার্থই সবকিছুর মূল কারণ। তা সর্বব্যাপ্ত এবং সর্ব কারণের কারণ।
মহান বৈষ্ণব দার্শনিক শ্রীল বলদেব বিদ্যাভূষণ তাঁর গোবিন্দ-ভাষ্য নামক বেদান্ত সূত্রের ভাষ্যে অত্যন্ত সুন্দরভাবে জড়বাদীদের সিদ্ধান্ত বিশ্লেষণ করেছেন। তিনি সমস্ত সাংখ্য সিদ্ধান্ত খন্ডন করেছেন, কেননা জগৎ সৃষ্টির তথাকথিত কারণগুলো খন্ডন করা হলে,সমগ্র সাংখ্য দর্শন খন্ডন করা যাবে। জড়বাদী দার্শনিকেরা প্রধানকে সৃষ্টির উপাদান ও নিমিত্ত কারণ বলে মনে করেন। তাঁদের কাছে প্রধানই হচ্ছে সবরকম সৃষ্টির কারণ। সাধারণত তাঁরা মাটি ও মৃৎপাত্রের দৃষ্টান্ত দেন। মাটি হচ্ছে মৃৎপাত্রের কারণ, কিন্তু মাটি সর্বত্রই দেখা যায়। গাছ জড়, কিন্তু গাছ ফল উৎপাদন করে। জল জড়, কিন্তু জল গতিশীল। এভাবেই সাংখ্য দার্শনিকেরা বলেন যে, জড় পদার্থ গতি ও সৃষ্টির কারণ। এতএব, প্রধানই জগতের উপাদান ও নিমিত্ত কারণ। এই মতবাদ খন্ডন করার জন্য শ্রীল বলদেব বিদ্যাভূষণ প্রধানের প্রকৃতি বিশ্লেষণ করে বলেছেন-
জড়া প্রকৃতি অচেতন এবং তাই তা জগতের উপাদান বা নিমিত্ত কারণ হতে পারে না। জড় জগতের বিচিত্র রচনা ও আয়োজন স্বতঃসিদ্ধভাবে প্রমাণ করে যে, সেই আয়োজনের পেছনে একজন চেতন পরিচালক রয়েছেন, কেননা চেতন পরিচালক ব্যতীত এরকম সুসংবদ্ধ আয়োজন সম্ভবপর নয়। চেতনের পরিচালনা ব্যতীত এই রচনা হতে পারে বলে অনুমান করা সঙ্গত নয়। আমাদের ব্যবহারিক অভিঙ্গতায় আমরা দেখতে পাই যে, অচেতন ইটগুলো নিজে নিজেই একটি প্রসাদ তৈরি করতে পারে না।
মৃৎপাত্রের দৃষ্টান্তকে স্বীকার করা যায় না, কেননা একটি মৃৎপাত্রের সুখ ও দুঃখের অনুভূতি নেই। এধরনের অনুভূতিগুলো জড়াতীত চেতনাপ্রসূত। সুতরাং, স্থুল দেহ অথবা মৃৎপাত্রের দৃষ্টান্ত এই সূত্রে যথাযথ নয়।
জড় বৈজ্ঞানিকেরা কখনো কখনো বলে যে, মালীর সহায়তা ছাড়াই মাটি থেকে গাছ গজায়, কেননা সেটি হচ্ছে জড়ের স্বাভাবিক প্রবণতা। তারা এও বলে যে, জন্ম থেকে জীবের যে স্বতঃস্ফূর্ত জ্ঞান, তাও জড়। কিন্তু দেহচেতনা আদি স্বতঃস্ফূর্ত জ্ঞানকে স্বতন্ত্র বলে স্বীকার করা যায় না, কেননা তাহলে দেহে আত্মার অস্তিত্ব স্বীকার করতে হয়। প্রকৃতপক্ষে, গাছ অথবা জীবদেহের কোনো প্রবণতা বা স্বতঃপ্রজ্ঞা নেই; এই প্রবণতা ও স্বতঃপ্রজ্ঞার প্রকাশ হয় দেহে আত্মার উপস্থিতির ফলে। এ সম্পর্কে একটি গাড়ি ও গাড়ির চালকের দৃষ্টান্ত দেওয়া যায়। গাড়ি চলতে পারে এবং বামদিকে ডানদিকে মোড় ফিরতে পারে, কিন্তু তা বলে কেউ বলতে পারে না যে, জড় পদার্থ গাড়িটি চালকের পরিচালনা ব্যতীতই চলতে পারে অথবা ডানদিকে বামদিকে মোড় ফিরতে পারে। চালকের চরিচালনা ব্যতীত গাড়িটির স্বতন্ত্রভাবে চলার প্রবণতা বা স্বতঃপ্রজ্ঞা নেই।
তেমনই, অরণ্যমধ্যে গাছের বৃদ্ধি সম্বন্ধেও এই একই তত্ত্ব প্রযোজ্য। গাছের বৃদ্ধি হয় গাছটির মধ্যে আত্মার উপস্থিতির প্রভাবে। কিছু মূর্খলোক চালের স্তুপে বৃশ্চিকের জন্ম হতে দেখে মনে করে, চাল হচ্ছে বৃশ্চিকের উৎপত্তির কারণ। প্রকৃতপক্ষে, স্ত্রী বৃশ্চিক চালে ডিম পাড়ার ফলে, উপযুক্ত অবস্থায় যথাসময়ে ডিম থেকে নতুন বৃশ্চিকের জন্ম হয় এবং তারা সেখান থেকে বেরিয়ে আসে। তার অর্থ এই নয় যে, চাল থেকে বৃশ্চিকের সৃষ্টি হয়েছে।
তেমনই, কখনো কখনো বিছানা থেকে ছারপোকা বেরিয়ে আসতে দেখা যায়। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, বিছানাটি ছারপোকা জন্ম দিয়েছে। বিভিন্ন রকমের প্রাণী রয়েছে। তাদের কেউ জরায়ুজ, কেউ অন্তুজ এবং কেউ স্বেদজ। বিভিন্ন জীবের আবির্ভাবের বিভিন্ন উৎস রয়েছে, কিন্তু তাই বলে জড় পদার্থকে জীবের উৎপত্তির কারণ বলে কখনোই স্থির করা উচিত নয়।
জড়বাদীরা যে মাটি থেকে স্বতঃস্ফুর্তভাবে গাছের জন্ম হওয়ার দৃষ্টান্ত দেয়, সেই যুক্তিও এই দৃষ্টান্তের দ্বারা খন্ডন করা যায়। কোনো বিশেষ অবস্থায় মাটি থেকে জীব বেরিয়ে আসে। বৃহদারণ্যক উপনিষদের বর্ণনা অনুসারে, দৈবের অধ্যক্ষতায় প্রতিটি জীব তার পূর্বকৃত কর্ম অনুসারে বিশেষ শরীর লাভ করতে বাধ্য হয়। বিভিন্ন রকমের শরীর রয়েছে এবং দৈবের অধ্যক্ষতায় জীব বিভিন্ন ধরনের শরীর গ্রহণ করে।
কেউ যখন মনে করে, ‘আমি এই কাজটি করছি, তখন ‘আমি’ বলতে দেহকে বুঝায় না। তা দেহের অতীত কোনোকিছু বা দেহাভ্যন্তরীণ কোনোকিছুকে বোঝায়। সেই হেতু, দেহের কোনো প্রবণতা বা স্বতঃপ্রজ্ঞা নেই; প্রবণতা ও স্বতঃপ্রজ্ঞা হচ্ছে দেহাভ্যন্তরীণ আত্মার। জড় বৈজ্ঞানিকেরা কখনো কখনো বলেন, স্ত্রী-শরীর ও পুরুষ-শরীরের স্বভাবিক প্রবণতার ফলে তাদের মিলন হয় এবং তার ফলে সন্তানের জন্ম হয়। কিন্তু সাংখ্য-দর্শন অনুসারে, পুরুষ যেহেতু সর্বদাই অবিচলিত, তাহলে তার সন্তান প্রজননের প্রবণতা আসে কোথা থেকে?
জড় বৈজ্ঞানিকেরা কখনো দুধের আপনা থেকেই দধিতে পরিণত হওয়ার দৃষ্টান্ত দেন এবং মেঘ থেকে পতিত পরিসুত বৃষ্টির জলের মাটিতে পতিত হয়ে বিভিন্ন গাছপালা এবং বিবিধ ফুলে-ফলে বিভিন্ন গন্ধ ও রসের সৃষ্টি করে। এই দৃষ্টান্তটি খন্ডন করে বৃহদারণ্যক উপনিষদে উক্তিটির পুনরুল্লেখ করে বলা হয়েছে যে, উৎকৃষ্ট শক্তির পরিচালনায় বিভিন্ন রকম জীবদের বিভিন্ন রকম শরীরে স্থাপন করা হয়েছে- পুনঃপুনঃ এভাবেই চলছে। দৈব নিয়ন্ত্রণাধীনে জীব তার পূর্বকৃত কর্ম অনুসারে বিভিন্ন রকমের শরীর প্রাপ্ত হয় এবং তার ফলে বিভিন্ন ধরনের প্রবণতা প্রকাশ করে।
ভগবদগীতাতেও (১৩/২২) প্রতিপন্ন হয়েছে-